ম্যান্ডারিন ভাষায় সংকট একটি যুক্ত শব্দ। প্রত্যেকটি শব্দের জন্য একটি প্রতীক ব্যবহৃত হলেও ম্যান্ডারিন ভাষায় সংকট লিখতে দুইটি প্রতীক সংযুক্ত করে দেওয়া হয়। দুইটি প্রতীকের প্রথমটি হুমকী লিখতে, দ্বিতীয়টি সুযোগ লিখতে ব্যবহৃত হয়। বিশ্ব মহামারী করোনার কারণে বাজারজাতকরণ মহা সংকটে আছে। আবার এই সংকটকেই সুযোগ হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করতে হবে বাজারজাত করণের সাথে সংশ্লিষ্টদের।

রিসেশন( পড়তি) আর ডিপ্রেশনের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে ” যখন দেখবেন আপনার পাশের দোকান বা ব্যবসায়টি বন্ধ হয়ে গেছে সেটা হল রিসেশন; আর আপনার দোকান বা ব্যবসায়টাও যখন বন্ধ হয়ে যাবে তখন তা ডিপ্রেশন। ” ইতিহাসে বহু মন্দা এসেছে এবং চলেও গেছে৷ মন্দার পরই আবার বাজার ঘুরে দাঁড়ায়। করোনা সৃষ্ট মন্দা থেকেও একদিন পৃথিবী ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু অনেকেই মনে করে সে বিশ্ব হবে বদলে যাওয়া এক বিশ্ব। মার্কিন বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কির মতে, “… এই পৃথিবীর ভুলগুলো বুঝতে সহায়ক হবে। অকার্যকর আর্থ সামাজিক ব্যবস্থার গভীরে তাকানোর সুযোগ দেবে। যার পরিবর্তন আবশ্যক, যদি আমরা চাই একটি বাসযোগ্য পৃথিবী।”

অর্থনীতির ভালো সময়ে বাজারীরা ভুলে যায় তাদের বিক্রয় বৃদ্ধি কেবলমাত্র তাদের সফল বিজ্ঞাপন ও আবেদনময়ী পণ্যের আকর্ষনে নয়। ভোক্তার ক্রয় নির্ভর করে ইচ্ছেমতো ব্যয়ের জন্য পর্যাপ্ত আয় ( ডিসক্রেশনারী ইনকাম), ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তার অনুভূতি, ব্যবসা ও অর্থনীতির উপর আস্থা, এবং তাদের জীবন ধাঁচ ও মূল্যবোধ দ্বারা ভোগ প্রবাহিত হয়।

আমেরিকার ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ রিসেশনের পদচিহ্ন দেখার জন্য নিম্নোক্ত অবস্থাকে বুঝিয়েছেন, ” Significant decline in economic activity spreads across the economy, lasting more than a few months.”

আরেকটি সংজ্ঞা হচ্ছে, GDP তে পরপর দুই কোয়ার্টার ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দেখা দিলেই মন্দা বলা যাবে। সংজ্ঞা যেটাই ধরি না কেন, ফল একইঃ চাকরি হারানো, প্রকৃত আয় কমে যাওয়া, শিল্প উৎপাদনের গতি মন্থর হওয়া, ভোগ ব্যয়ের আধোগতি, চাহিদা হ্রাস এবং অনিশ্চয়তার ভয়। মন্দার প্রায় সবকটি লক্ষ্মণ বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশেও এ সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া, বেকারের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাওয়া, অথবা কর্মহীন হওয়ার ভয়ে খরচ কমিয়ে দেওয়া, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় আরো কমে যাওয়া; সব লক্ষ্মণ নিয়েই একটি দীর্ঘমেয়াদী মন্দার কবলে পড়ার আশঙ্কা প্রায় বাস্তব হতে চলছে বাংলাদেশে।

এই সংকটকালে মার্কেটিং এর লোকজন কী করবে? পেশাদার মার্কেটার্সদের প্রথম কাজ হচ্ছে কোম্পানিকে টিকিয়ে রাখা। ACI গ্রুপের কনজুমার ব্রান্ডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সৈয়দ আলমগীর সম্প্রতি যেমনটা বলেছেন, ” বেঁচে থাকলে মুনাফা করা যাবে। ” এই বেঁচে থাকা বলতে তিনি কোম্পানি, কর্মচারী, ক্রেতা এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদেরকে বুঝিয়েছেন। চাহিদা কমে গেলে উৎপাদন কমে যাবে বা বন্ধ হয়ে যাবে; ফ্যাক্টরি বন্ধ হলে উৎপাদন ও বিতরণের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের চাকরি সংকটে পড়বে। অনেক কোম্পানি অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে কর্মচারীর সংখ্যা কমিয়ে অল্প লোক দিয়ে বেশি কাজ করাতে চাইবে। এতে বেকারত্ব বাড়বে, বেকারত্ব বাড়লে, বাজারে ক্রয় ক্ষমতা কমে গেলে আংশিকভাবে চালু উৎপাদন ব্যবস্থাও বন্ধ হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে কর্মচারী ও কোম্পানি মিলে ঠিক করবে চাকরি ও কোম্পানি বাঁচানোর পদ্ধতি। আমাদের দেশের অনেক কোম্পানির নির্বাহীরা তাদের বেতনের কিছু অংশ ত্যাগ করলেও নিম্ন বেতনের অনেক কর্মচারীর চাকরি বেঁচে যাবে। ক্রেতাকে বাঁচাতে পণ্যমান ও সেবার অগমেন্টেড অংশটুকু বাদ দেওয়া যেতে পারে। কোর বেনিফিট, মৌলিক পণ্য, এবং ক্রেতার প্রত্যাশার বাইরে যা যোগ করা হচ্ছে তা পরিহার করা গেলে পণ্যদাম কমানো সম্ভব হবে।

টুথ পেস্টের কাগজের হার্ড প্যাকেট বাদ দিয়ে কেবল একই মানের টিউবটা রাখলে টুথপেষ্টের দাম ৫/১০ টাকা কমানো যাবে। যেহেতু ক্রেতার আরাধ্য পণ্যটা একই থাকছে, সেহেতু দাম কমালে মান নিয়ে তাদের কোন সন্দেহ হবে না। অনেকক্ষেত্রে আগের দামে আগের সাইজের প্যাকেটে কম পণ্য দিয়েও সমস্যা মোকাবেলা করতে দেখা গেছে। বিজ্ঞাপন খরচ কমিয়ে বিজ্ঞাপনের সাশ্রয়ী টাকা বাজারজাতকরণ মিশ্রণের অন্যান্য উপাদানে পুনঃবন্টন করা যেতে পারে। মন্দার সময়ও যেসকল পন্যের বিক্রয় আগের মত থাকে সেগুলো হল ভোক্তার আবশ্যকীয় পণ্য বা Consumer staples. যেমন, টুথপেষ্ট, সাবান, শ্যাম্পু, ডিটারজেন্ট, থালা বাসন ধোয়ার সাবান, টয়লেট পেপার, টিস্যু ইত্যাদি। অর্থনৈতিক খারাপ অবস্থাতেও পুরুষ ও মহিলারা তাদের সামাজিক ও কর্মক্ষেত্রে তাদের ভাল দেখা যাক এটা চায়, তাই কসমেটিক বা এ জাতীয় পণ্যের চাহিদা মন্দার সময়ও খুব বেশি কমে না। ACI, MGI বা বসুন্ধরা গ্রুপের মত কনগ্লোমারেট ব্যবসায় হাউসগুলো ক্রস সাবসিডাইজেশনের পথ ধরতে পারে। অর্থাৎ এক খাতের আয় দিয়ে অন্য খাতকে আপাতত টিকিয়ে রাখা।

কিছুকিছু ব্যতিক্রম দাঁড়ায়, মন্দার সময় চাহিদা হ্রাস মূল্য হ্রাসের তীব্র চাপ সৃষ্টি করে। তবে মজার ব্যাপার হল, মন্দার সময় চাহিদার মূল্য স্থিতিস্থাপকতা বাড়ে। মূল্য হ্রাস করলে স্বাভাবিকের চেয়ে চাহিদা বেশি বাড়ে। তখন কোম্পানি তার আটকে পড়া পণ্য বিক্রয় করে ক্যাশ টাকার ঘাটতি কমিয়ে কোম্পানিকে ব্যবসার বাইরে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। যেমন সুপার চেইন ‘স্বপ্ন’ করেছে, দীর্ঘদিন লোকসানে থাকা কোম্পানিটির টিকে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

মন্দার সময় পণ্যের দামের ব্যাপারে কৌশল ঠিক কী হবে তা অনেকাংশেই পণ্যের ধরনের উপর নির্ভর করে। অত্যাবশ্যকীয় সাধারণ বা কম মানের পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাবে বা অপরিবর্তনীয় থাকবে তাই দাম কমানোর প্রয়োজন নেই। বিলাস দ্রব্য যেগুলোর ক্রয় বিলম্বিত করা যায় তার চাহিদা কমে যাবে। এসকল পণ্যের মূল্য হ্রাস করে ক্যাশফ্লো অব্যাহত রাখা যায়। সমহারে মূল্য স্থিতিস্থাপক পণ্যের মূল্য হ্রাস করে কোন লাভ হবে না। এক্ষেত্রে মূল্য প্রতিযোগিতা অস্ত্র ছাড়াও অন্যান্য অস্ত্র ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন- লয়েল্টি কার্ড, উন্নততর বিক্রয়োত্তর সেবা।

মন্দাকালীন সময়ে কার্যকর পাঁচটি বিক্রয় কৌশল হচ্ছে-

১. সম্ভব হলে পন্যের অবমূল্যায়ন না করা। এমনটি করলে ক্রেতা মনে করতে পারে কোম্পানিটি আগে অধিক মূল্য নিয়ে তাকে ঠকিয়েছে। মূল্য হ্রাসের চেয়ে অধিক সময়ের গ্যারান্টি অথবা কারিগরি সহায়তা বাড়িয়ে ভাল ফল পাওয়া গেছে।

২. শান্ত থাকা এবং পণ্যের চেয়ে সমাধানের প্রতি বেশি মনযোগী হওয়া, বিক্রয়কর্মীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যেন অতিমাত্রায় এগ্রেসিভ বা বিক্রির জন্য মরিয়া হয়ে না উঠে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

৩. অল্প সংখ্যক সম্ভাব্য ক্রেতার প্রতি মনোযোগী হতে হবে। তবে তাদের সাথে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে।

৪.পুরাতন ক্রেতাদের প্রতি মনোযোগ কমানো যাবে না।মনে রাখতে হবে নতুন ক্রেতা ধরার চেয়ে পুরনো ক্রেতা ধরে রাখা কম ব্যয়বহুল।

৫.বিক্রয়কর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রেষণা ও প্রণোদনার মাধ্যমে পেশাগত মানোন্নয়নের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
==============================

সব মন্দা একরকম হয় না। বাজার মোকাবেলার কৌশলও একরকম হবে না। স্বাভাবিক সময়ে বাজারীরা তাদের উদ্ভাবন ও বিজ্ঞাপন দিয়ে পৃথিবীটাকে বদলাতে চায়। সংকটকালে বাজারীরা নিজে বদলে নতুন “নরম্যাল” এর সাথে খাপ খাওয়াবে। করোনা সৃষ্ট সংকট আমাদের অর্থনীতিতে দীর্ঘায়িত হবে, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। WHO -এর বিশেষজ্ঞ মাইক রায়হান যেমনটি বলেছেন, টিকা দিয়ে এই ভাইরাস সম্পূর্ণ নির্মূল হবে না। হামের টিকা দেয়া হচ্ছে হাম নির্মূল হয়নি, এইচআইভি এর টিকা আবিষ্কার হয়নি। করোনার সাথেই আমাদের অনেকদিন থাকতে হবে, তবে বিশ্ব মহামারী আকারে বেশি দিন থাকবে না, যা থাকবে মহামারীর কারণে সৃষ্ট মন্দা। তবে মন্দাও কোন অর্থনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী হয় না। প্রত্যেকটি মন্দার তিনটি স্তর থাকে– প্রাথমিক বিক্রয় কমে যাওয়া , ধীরে ধীরে বিক্রয় ফিরে আসা, এবং ঘুরে দাঁড়ানো অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি। মন্দার প্রভাব নির্ভর করে বাজার পতনের গভীরতার উপর এবং স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে কত সময় লাগে তার উপর। এ মুহূর্তে আমরা অতল পড়তির দিকে আছি। কোথায় গিয়ে ঠেকবে তাও বলা যাচ্ছে না। বাজারজাতকরণের সাথে সংশ্লিষ্টরা এ সময় হাত গুটিয়ে বসে থাকলে মন্দার ক্ষতের গভীরতা আরো বাড়বে। এখনই টিকে থাকার ভিত্তি তৈরি করতে হবে যার উপর কোম্পানি দাঁড়িয়ে থাকবে। ব্যাপক খরচ কমিয়ে নগদ টাকা সংরক্ষণ করার নীতি কোম্পানির পতনের গর্তকে গভীর করবে। খরচ কমিয়ে স্বল্পমেয়াদে কিছু অর্থ সাশ্রয় করা গেলেও মহামারী কেটে গেলে এর ফল হিতে বিপরীত হবে। মন্দা কালে খরচ না কমানো কোম্পানিগুলোর নিকট হারানো বাজার পুনঃদখল করার জন্য যে পরিমাণ ব্যয় করতে হবে তা মন্দা কালে খরচ বাঁচিয়ে সাশ্রয়ী অর্থের অনেক বেশি হবে। আগের ধাঁচে চলার অর্থ হচ্ছে কোম্পানি মন্দার ক্ষতের গভীরতা কমানোর জন্য বিনিয়োগ করছে না। মনে রাখতে হবে প্যারাসুটধারী যাত্রীরাই কেবল আকাশে ক্রাশ করা উড়োজাহাজ থেকে জায়গা মতো নামার চেষ্টা করতে পারবে। ক্রেতা গতকাল যা কিনতো আজ বা আগামীকাল তা কিনবে না। ক্রেতার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চাহিদার সাথে সংগতি রেখে উদ্ভাবনই বাঁচাতে পারে কোম্পানিকে।

করোনা পরবর্তী কালে ভোক্তারা দরিদ্র হয়ে যাবে অথবা তাদের মধ্যে দারিদ্র্যের অনুভূতি চলে আসবে। তারা অনেক ভেবেচিন্তে খরচ করবে। এই সময় বাজারীকে ক্রেতাকে অভয় দিয়ে বলতে হবে, ‘চলুন আমরা একসাথে মিলে সময়টা পাড়ি দেই’।

মন্দার সময় ক্রেতার সাথে থেকে পরিস্থিতি মোকাবেলাই হবে বাজারজাতকারীর একমাত্র উপায়। সাশ্রয়ী দামে যে কোম্পানি অনাড়ম্বর কিন্তু গুনে ভালো (গুড-ভ্যালু) এমন পণ্য বিক্রি করবে তারাই মন্দার সময় ভালো করবে। ন্যূনতম বিজ্ঞাপন দ্বারা সমর্থিত স্বল্প দামের পণ্যগুলো তাদের বাজার অংশ ধরে রাখতে পারবে। মধ্য আয়ের বাজার খণ্ডকে টার্গেট করা কোম্পানিগুলো এসময়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বাজারজাতকারীকে করোনা পরবর্তী দীর্ঘ মন্দা অর্থনীতির জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। মনে রাখতে হবে গতি কমানো যাবেনা বরং সিট বেল্ট বেঁধে গতি বাড়াতে হবে। ক্রেতা বাজার থেকে কোন কিছু কিনেই ক্রয়কৃত পণ্য থেকে প্রাপ্ত সুবিধা মূল্যের সাথে টালি করে দেখবে। অনেক ক্রেতাই ভালো সময়ে এমন অনেক কিছু কেনে যা বছরের পর বছর ঘরেই পড়ে থাকে (যেমন ডিনার সেট, দামি বেড কভার) তারা হুজুগে পড়ে, চোখের ভাল লাগা বা অন্যের ক্রয়ে ঈর্ষান্বিত হয়ে বা প্ররোচিত হয়ে এমন পণ্য কিনে যা জীবনে এক দুই বার ব্যবহার করে অথবা কোনদিনই ব্যবহার করে না। এ ধরনের পণ্যের ক্রয় কমে যাবে। মন্দার সময় বাজার গবেষণার খরচ না কমিয়ে বরং বাড়াতে হবে। কোম্পানিকে জানতে হবে মন্দার সময় ভোক্তা কিভাবে ‘ভ্যালু’ কে পুন:সংজ্ঞায়িত করছে। কিভাবে ক্রেতার মূল্য স্থিতিস্থাপকতা রেখা পরিবর্তিত হচ্ছে। ক্রেতারা স্থায়ী পণ্য ক্রয় যাচাই-বাছাইয়ে বেশি সময় নেবে এবং দরকষাকষি করবে, ক্রয় বাতিল অথবা বিলম্বিত করবে অথবা পরিমাণে কম কিনবে। পণ্যের যে অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য (অগমেন্টেড প্রোডাক্ট )তাকে পুলকিত করতো মন্দার সময় সে এগুলো বাদ দিয়ে মৌলিক পণ্য পেতে চাইবে। বাজারে সুনামধারী কোম্পানিগুলো নতুন ব্র্যান্ড ছাড়তে পারে। তবে এক্ষেত্রে হঠাৎ উড়ে ধপ করে নিভে যাওয়ার (ফ্যাড) সম্ভাবনা আছে। ভোক্তার আগ্রহ স্থায়িত্ব নাও পেতে পারে।

করোনার কালে লকডাউন ও হোম কোয়ারান্টাইনের কারণে শহুরে ক্রেতারা পরিবারমুখি হবে ৪০ দিন কোন জীবন ধাঁচ টানা মেনে চললে সেটা অনেকেরই কিছুকালের জন্য হলেও অভ্যাসে পরিণত হয়ে বলে অনেক সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন। তাই করোনা উত্তর বাজারে ক্রয় কালে পরিবার প্রাধান্য পাবে। সামাজিক দূরত্ব এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে রেস্টুরেন্ট চালাতে হবে। তখন রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়ার চেয়ে বাড়িতে নিয়ে পরিবারের সাথে খাওয়ার প্রবণতা বাড়বে। তখন কেএফসি বা বার্গার কিং এর ফ্যামিলি প্যাকের জনপ্রিয়তাও বাড়বে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে গিয়ে অনেক রেস্টুরেন্টের দরজা বন্ধ করে জানালা খুলতে হবে ‘থ্রো ওয়ে’ বিক্রির জন্য।

এসময়ে বিজ্ঞাপন খরচ কমানো যাবে না। মন্দার সময় বিজ্ঞাপন কমিয়ে ভালো ফল পাওয়া যায় না। কেউ কেউ এসময়ে বিজ্ঞাপন বাড়িয়ে প্রতিযোগীর বাজার অংশ দখল করে নিবে। এসময়ে বহিরাঙ্গন বিনোদন অপেক্ষা ভোক্তারা ঘরেই বেশি সময় কাটাবে এবং টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি বেশি নজর দিবে। তাই এসময়ে কম খরচে বিজ্ঞাপনের বার্তা নিয়ে সহজেই ক্রেতার নিকট পৌঁছানো যাবে। এসময়ে মিডিয়াগুলো আর্থিক টানাটানির মধ্যে থাকে বিধায় কম খরচে বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য তাদেরকে সহজে রাজি করানো যায়। বিজ্ঞাপনের দৈর্ঘ্য কমিয়ে পৌনঃপুনিকতা বাড়ানো যায়।

কোম্পানিগুলোকে তাদের প্রত্যেকটা পণ্যের বিক্রয় পূর্বাভাস পুনঃবিবেচনা করতে হবে। কারণ ক্রেতারা পণ্যের অতিরিক্ত অপশনগুলো বাদ দিয়ে মৌলিক পণ্যের দিকে ঝুঁকবে। যে পণ্যের বহু ব্যবহার আছে ক্রেতা সেটা পেতে চাইবে । কম্বাইন্ড হারভেস্টার দিয়ে ধান কাটা ও মাড়াই করা যায় কিন্তু পাওয়ার টিলার এর সাথে হারভেস্টার যুক্ত করে দিলে পাওয়ার টিলারের চাহিদা বাড়বে, কারণ পাওয়ার টিলার দিয়ে কৃষক ইতিমধ্যেই অনেকগুলো কাজ করে।

মুদি পণ্যের জাতীয় ব্র্যান্ডগুলোর কিছু জায়গা দখল করবে বিক্রয়কারী দোকানদারের নিজস্ব ব্র্যান্ড । অবস্থা এমন দেখা গেলে জাতীয় ব্র্যান্ডের কোম্পানিগুলো বস্তায় ভরে বাল্ক হিসেবে বাজারে পণ্য ছাড়তে পারে। এক্ষেত্রে স্থানীয় বিক্রেতা তার দোকানের নামে পণ্য প্যাকিং করবে। এই প্রক্রিয়ায় ব্র্যান্ডকৃত পণ্য বিক্রয় কারী কোম্পানির বিজ্ঞাপন ও বিতরণ খরচ কমবে, একই সাথে তার জাতীয় ব্র্যান্ডের বিক্রিও কমে যাবে। এই অবস্থাটা জাতীয় ব্র্যান্ডের জন্য মন্দের ভালো কারণ জাতীয় ব্র্যান্ডের পণ্য বাল্ক আকারে পাওয়া না গেলে বিদেশি পণ্য বা প্রতিযোগীর খোলা ও অপ্যাকেটকৃত পণ্য দিয়ে দোকানিরা নিজস্ব ব্র্যান্ডিং শুরু করলে অবস্থা আরো খারাপ হবে।

শিল্পপণ্যের ক্রেতারা পণ্য ও সেবা আলাদা করে পেতে চাইবে । মূল্যও আলাদাভাবে নির্ধারণ করতে চাইবে। পুরোনো ক্রেতারা সেবা বাদ দিয়ে কেবল শিল্প পণ্যটি পেতে চাইবে কারণ পুরনো ব্যবহারকারীরা নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে পণ্যটি ব্যবহার করতে চাইবে।

দৃষ্টি আকর্ষনী (gimmick) উপাদানের চেয়ে নির্ভরযোগ্যতা, স্থায়িত্ব, নিরাপত্তা এবং কার্যসম্পাদন বেশি গুরুত্ব পাবে। ক্রেতাদের নতুন বাস্তবতা অনুধাবন করে যারা নতুন পণ্য বাজারে নিয়ে আসবে তারা প্রতিযোগীর উপর চাপ তৈরিতে বেশি সমর্থ্য হবে। এ সময় পণ্যের মূল্য এবং কার্যসম্পাদন যোগ্যতার প্রতি বেশি নজর দিতে হবে। মন্দার সময় “কর্পোরেট ইমেজ” পৃথকীকরণের হাতিয়ার হিসাবে তেমন কার্যকর থাকে না।

মন্দার সময় কোন বিতরনকারী অতিরিক্ত পণ্য মজুদ করে বেশি ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল আটকাতে চাইবেনা। দ্রুত ক্রয় করলে, বেশি পরিমাণে ক্রয় করলে বা প্রোডাক্ট বান্ডেল (ধীরে চলা ও দ্রুত চলা পণ্যের মিশ্রণ ) ক্রয় করলে, বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে বিতরণ কারীর গুদামে বেশি পণ্য ঢুকানো যেতে পারে। বাজারে নতুন আসা পণ্যের ক্ষেত্রে এই কৌশল ফলপ্রসূ হতে পারে। তবে সুনামবিহীন যেনতেন চ্যানেলে পণ্য মজুদের চেষ্টা করলে ব্র্যান্ড ইমেজ ক্ষুন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে অদক্ষ বিতরণ কারীদের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার এটাই মোক্ষম সময়। অদক্ষ কোম্পানির দক্ষ এবং ভালো চাকরি হারানো বিক্রয়কর্মীদের নিজের কোম্পানিতে টানার ভালো সময় হচ্ছে মন্দা কাল। আর্থিক টানাটানিতে থাকা ক্রেতাদের কিস্তিতে মূল্য পরিশোধের সুযোগ দেয়া যেতে পারে। ছোট প্যাক মিনিপ্যাক ছেড়েও এ ধরনের ক্রেতাদের ধরে রাখা যেতে পারে। সাশ্রয়ী জ্বালানি, উন্নত প্রযুক্তি, ভিন্ন কাঁচামাল ব্যবহার করে ব্যবসায়ের খরচ কমিয়ে পণ্যের মূল্য কাঠামো সমন্বয় করে বাজার অংশ ধরে রাখার চেষ্টা করতে হবে। এ সময় মূল্য নীতির উদ্দেশ্য হওয়া উচিত বাজারে টিকে থাকা এবং বাজারের অংশ ধরে রাখা। এসিআই কনজিউমার ব্র্যান্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আলমগীর যেমনটি বলেছেন,-” টিকে থাকলে মুনাফা হবে”। করোনা লক ডাউন এর সময় এসিআই তার ভোগ্য পণ্যের দাম কেজি বা লিটারপ্রতি ৪/৫ টাকা করে কমিয়ে দিয়েছে।

সবশেষ কথা হচ্ছে কোম্পানির প্রধান নিবার্হীকে তার ক্রেতা ও কর্মচারীসহ অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের প্রতি অধিক মনোযোগী হতে হবে।
==============================================

বিক্রয় মানুষের আদিমতম পেশা। আমরা প্রত্যেকে কিছু একটা বিক্রয় করেই বেঁচে আছি। ব্যবসায় এবং অব্যবসায়ী সকল প্রতিষ্ঠানে বিক্রয় কর্মী কাজ করে। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মীরা বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে ছোট পরিবারের ধারণা এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী নিয়ে। কৃষি বিভাগের ব্লক সুপারভাইজাররা যাচ্ছে ফসল বৈচিত্র্যকরণ কর্মসূচির আওতায় ভুট্টা চাষে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করতে। বিভিন্ন নামে তারা বিক্রয় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বিক্রয়ের সাথে জড়িত লোকদের বিভিন্ন নামে ডাকা হয় যেমন- বিক্রয়কর্মী, বিক্রয় প্রতিনিধি, এজেন্ট, বিক্রয় উপদেষ্টা, বিক্রয় প্রকৌশলী, মাঠকর্মী ইত্যাদি। বিক্রয় কর্মীর একটা চিরায়ত রূপ আছে যা অনেক বিক্রয়কর্মীই ধারণ করেন। বিক্রয় কর্মীর কথা মনে করতেই মনে পড়ে যায় আর্থার মিলারের “ডেথ অফ এ সেলসম্যান” এর নায়ক উইলি লোমান অথবা Meredith wilson এর “দা মিউজিক ম্যান” এর নায়ক হ্যারল্ড হিলের কথা। আমরা প্রতিদিন বিক্রয় কর্মীর সাহায্য নেই কিন্তু তাদেরকে সমাজে আমরা যথোপযুক্ত স্থান দেই না।

করোনার যুদ্ধে বিক্রয়কর্মীদের ফ্রন্টলাইন ফাইটার হিসেবে অবহিত করলে অন্যদের কোনোভাবেই হেয় করা হবে না। যেমন ডাক্তার,নার্স , স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, সেনাবাহিনী বা মিডিয়াকর্মী সবাই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে করোনা মোকাবেলায় ভূমিকা রাখছে। বাড়িতে আবদ্ধ হয়ে থাকাও এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ হিসেবে বিবেচিত হয়। হাসপাতালে, রাস্তায় অথবা বাড়িতে যে যেখানেই থাকুক তাদের খাবার, ত্রাণ সামগ্রী , মাস্ক, ঔষধ, পিপিই সবকিছু ঠিকমত পৌঁছে যাচ্ছে বিক্রয়কর্মীদের নিরলস প্রচেষ্টায়। সব মিলিয়ে বিক্রয় কর্মীদের সংখ্যা ৪০ লক্ষ হবে বলে আমার ধারণা। শুরুতে বিক্রির যে সংজ্ঞা দিয়েছি তা ধরলে তো আমরা সবাই বিক্রয় কর্মী। আপাতত আমরা যাদের অংশগ্রহণের চূড়ান্ত ফলস্বরূপ আমাদের আরাধ্য জিনিসটা পেয়ে যাই তাদের কথাই এই নিবন্ধের বিষয়বস্তু। করোনা পরবর্তী সময়ে যে মন্দাবস্থা দেখা দিবে তার সরাসরি আঘাতে কিছু ব্যবসায় বন্ধ হয়ে যাবে, কিছু ব্যবসায় টিকে যাবে এবং আস্তে আস্তে ফিরে আসবে, তবে ভিন্ন চরিত্র নিয়ে। কিছু ব্যবসা আগের চেয়ে শক্তিশালী হবে এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উপযুক্ততা অর্জন করবে। বিক্রয়কর্মীরা এই তিনটির যেকোনো একটি শ্রেণীতে পড়তে পারে। চাকরি হারিয়ে ভিন্ন পেশায় চলে যাওয়া বা বেকারত্ব, নতুন অবস্থানের সাথে উপযুক্ত হয়ে টিকে থাকা, অথবা নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আসন্ন সুযোগ গ্রহণ করে বিক্রয় পেশায় আরো উন্নতি করা। যারা দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দলভুক্ত হতে চায় তাদের জন্য সুপারিশ হচ্ছে: যতটা সম্ভব অনুগত ক্রেতার এডভোকেসি গ্রহণ করা। করোনা পরবর্তী সময়ে চমকপ্রদক বিজ্ঞাপনের প্রভাব কমে যাবে। এমনিতেই McKinney Research বলছে, আমাদের মতো দেশে প্রায় ৫০% ক্রেতা অন্যের মুখের কথায় বিশ্বাস করে পণ্য কিনে। বিজ্ঞাপনের বার্তা অনেকের কাছে পৌঁছে না। যাদের কাছে পৌঁছে তারাও আবার বিশ্বাস করে না। বেশিরভাগ আবেদন আবেগী হওয়ায় বিজ্ঞাপনের কার্যকারিতা আরো কমে যাবে। এমনিতেই বিজ্ঞাপনের মডেলরা যা বলে তা যে টাকার বিনিময়ে বলে তা ক্রেতারা জেনে গেছে। অবশ্য এটাকেও বিজ্ঞাপনের বিষয়বস্তু করতে দেখেছি। এক মডেল বাথটাবে শুয়ে গায় একটি ব্র্যান্ডের কোমল পানীয় ঢেলে বলছে,” এই হচ্ছে আমার রুপ-লাবণ্যের রহস্য “। দূর থেকে আরেক মডেল বলছে,”পয়সা পেয়ে কত কিছু বলছে,বিশ্বাস করো না খেয়ে দেখো”। এ ধরনের আবেগীয় বিজ্ঞাপন টানাটানির অর্থনীতিতে তেমন কার্যকর হবে বলে মনে হয় না। মানুষ যৌক্তিক প্রমাণ পেতে চাইবে। সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ হচ্ছে অন্যের “মুখের কথা”। বিক্রয়কর্মীদেরকে সন্তুষ্ট ক্রেতাদেরকেই রেফারেল হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। সন্তুষ্ট ক্রেতাদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করে তাদের মাধ্যমেই নতুন ক্রেতার কাছে পৌঁছাতে হবে।

বিক্রয়কর্মীদের বর্তমান ক্রেতাদের ধরে রাখার জন্য বেশি সময় দিতে হবে। পড়তি বাজারে নতুন ক্রেতার পেছনে হন্যে হয়ে না ঘুরে পুরনো ক্রেতাদের প্রতি বেশি মনোযোগ দিতে হবে। এই কৌশল কোম্পানির বিক্রয় ধসকে আটকে দিবে। কোম্পানির বিক্রয় কমে যাওয়ার কারণ হচ্ছে “লস্ট কাস্টমার” অর্থাৎ যারা আগে এই কোম্পানির পণ্য কিনত এখন কিনছে না। একই পণ্য অন্য কোম্পানির কাছ থেকে কিনছে। ক্রেতারা কেন কোম্পানি বদল করে এ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে ১৫% ক্রেতা চলে যাওয়ার কারণ তারা কম দামে জিনিস পেয়ে চলে গেছে। ১৫% আরো ভালো জিনিস পেয়েছে। ৭০% চলে যাওয়া ক্রেতার অভিযোগ হচ্ছে , “আমাদের প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেয়া হয়নি”। মন্দার সময় বিক্রয়কর্মীর তাড়াহুড়ো না থাকায় হাতে কিছু সময় বাঁচবে। হাতের সময় ক্রেতা সন্তুষ্টির মানোন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে। অপ্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা পরিহার করে কিভাবে ক্রেতা সেবা পদ্ধতির আরো উন্নয়ন ঘটানো যায় সে চেষ্টা করতে হবে। সন্তুষ্ট ক্রেতাই হবে কোম্পানির আয়ের প্রধান উৎস।

শিল্পপণ্যের বিক্রয় কর্মীদের নতুন শিল্প খুঁজে বের করতে হবে। অনেক শিল্প করোনা পরবর্তী মন্দা মোকাবেলায় কাঁচামাল, উৎপাদন প্রক্রিয়া বদলে ফেলবে। পুরনো প্রবাদ “প্রয়োজনই হচ্ছে উদ্ভাবনের মা”। অনেক কোম্পানি তাদের ব্যয় সাশ্রয় ও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য ভিন্ন কিছু খুঁজবে। বিক্রয়কর্মীকে তার পণ্য নতুন কোন শিল্পে ব্যবহৃত হতে পারে তা খুঁজতে হবে। অর্থনীতি ভালোর দিকে যাত্রা শুরু করলে তারাই হবে কোম্পানির বড় ক্রেতা। যারা বলতো আপনার পণ্য আমাদের কোনদিনই লাগবেনা এই ‘মাইন্ডসেট’ থেকে তাদের বের করে আনতে হবে। বিচারপতি বা উকিলরা আমাদের দেশে অনলাইনে বিচারকার্য পরিচালনা হবে তা ভাবতে পারে নাই। জমির দলিলের কম্পিউটার প্রিন্ট পাওয়া যাবে, রিক্সা ভাড়া বিকাশে পরিশোধ করা যাবে অথবা রিক্সা চলবে ব্যাটারীতে, ফুটপাতে ভুট্টা পোড়ানোর জন্য ব্লোয়ার ব্যবহৃত হবে এটা কেউ ভাবেনি। চেষ্টা করলে দেখা যাবে অনেক শিল্পে নতুন বাজার খুঁজে পাওয়া যাবে।

নগদ প্রবাহকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ব্যবসায়কে টিকিয়ে রাখার জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর দ্বারা কোম্পানি তার সরবরাহকারীর নিকট সুনাম ধরে রাখে। এ সময় ক্রেতারা টাকা ছাড়তে চাইবে না। কিন্তু বিক্রয় কর্মীও তার সাথে তাল মিলালে ব্যবসায় চোরাবালিতে আটকে যাবে, ওঠা যাবে না। অলাভজনক ক্রেতাকে বিদায় করতে হবে। লাভজনক ক্রেতার প্রতি বেশি মনোযোগী হতে হবে। যারা নির্দিষ্ট সময়ে পাওনা পরিশোধ করবে তাদের বিশেষ আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।

মন্দা চলাকালে আগের ধাঁচের কর্মকাণ্ড অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। যে সকল কোম্পানি আগে থেকেই মন্দা মোকাবেলার প্রস্তুতি নেয় তারা মন্দার সময় ভালো করে। দুর্ঘটনাপ্রবণ জায়গায় গতি কমিয়ে সাবধানতার সাথে গাড়ি চালিয়ে যেমন অন্য ধাবমান গাড়িকে অতিক্রম করা যায় তেমনি প্রতিযোগীকে অতিক্রম করা যায়। তবে সোজা পথে গাড়ি চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার চেয়ে দুর্ঘটনা প্রবণ এলাকায় বা রাস্তায় গাড়ি চালানোর জন্য অতিরিক্ত দক্ষতা প্রয়োজন হয়। দক্ষতা দিয়েই মন্দার সময় প্রতিযোগী কোম্পানিকে টেক্কা দিতে হবে। যা আছে তা নিয়ে সোজা না হেঁটে ভবিষ্যতের পণ্যের দিকে নজর দিতে হবে। মন্দার সময় বেঁচে থাকাই যথেষ্ট নয়, আরো শক্তিশালী হিসেবে বাজারে অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করতে হবে। নিজের লোকদেরকে টেক কেয়ার করতে হবে। এসময় সবাই আতঙ্কে থাকে, চারিদিকে লো-অফের খবর আসে, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে সকলে। কোম্পানির নেতৃত্বকে সবাইকে চাকরি বেঁচে যাওয়ার অভয় দিতে হবে। বিক্রয় কর্মীদেরকে ভবিষ্যতের জন্য প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। প্রেরণামূলক আশার কথা বলতে হবে। কর্মীরা যখন নিরাপদ ভাববে তখন তারাও ব্যবসায়কে নিজের মতো করে দেখভাল করবে।
===================================

করোনার প্রতিঘাতে বদলে যবে ব্যবসায়ের ধরন। অন্তত এখন যেভাবে চলছে সেভাবে আর চলবে না। ‘নিউ নর্মাল’ যতক্ষণ না ‘রেগুলার নরমালে’ পরিবর্তন হবে ততক্ষণ স্বল্পমেয়াদী বড়জোর মধ্যমেয়াদী ব্যবসায় পরিকল্পনাকেই বেশি জোর দিতে হবে। অবশ্যই চলতি প্রবণতাগুলোর মধ্যে যেগুলো স্থিতু হবে সেগুলো পূর্বানুমান করে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার এখনই ছক তৈরি করতে হবে। গত কয়েক মাসে অনেক কিছুই বদলে গেছে।

ভোক্তারা অনেকেই আর্থিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে গেছে। ভোক্তার আচরণ বদলে যাচ্ছে। ভোক্তারা কোথায় কীভাবে কত টাকা খরচ করবে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করছে। ভোক্তার মনোজগৎ যে পরিবর্তন হচ্ছে তাতে তাঁর শোনার ও দেখার আগ্রহ পরিবর্তন হচ্ছে। প্রতিযোগিতার পরিবেশ বদলে যাচ্ছে। নতুন এক বাস্তবতার দিকে ঝুকছে ক্রেতা।

বর্তমান সময়টাই হচ্ছে ক্রেতার নিকট ব্যাবসায়ের ‘অর্পণ’ কে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরার মোক্ষম সময়। কোম্পানিকে তার অর্পণকে ভোক্তার সমস্যার ”সমাধান” হিসেবে তুলে ধরতে পারলে সুবিধাবাদীতা (opportunism) অপেক্ষা পরার্থবাদীতা (alterism) ভাবমূর্তি তৈরি সম্ভব হবে। কোম্পানি সংকটকালে কোন অন্যায় সুযোগ নিচ্ছে না বরং ক্রেতার সমস্যা সমাধানে কাজ করছে এটা কোম্পানির ইমেজ তৈরিতে বড় ধরণের ভূমিকা রাখবে। কোম্পানির পণ্যটি কার জন্য এটা নির্দিষ্ট করতে হবে। কোম্পানি কি তার টার্গেট পরিবর্তন করছে? অর্পণটির অন্তর্নিহিত সুবিধাটা কি? সংকটকালে কোম্পানির অর্পণের সুবিধাগুলো কি ক্রেতার নিকট গুরুত্বপূর্ণ? ক্রেতার সংকটকালীন কোন্ কোন্ নীডটিকে কোম্পানির অবস্থান গ্রহণের (positioning) হাতিয়ার হিসেবে নিচ্ছে সেটা সুনির্দিষ্ট করতে হবে। অস্থিরতার সময় মানুষ নীড মৌলিকতার দিকে ধাবিত হয়। বাহুল্যের প্রতি আকর্ষণ কমে যায়। মন্দার সময় অনুগত ক্রেতাদেরকেই বেশি করে স্মরণ করতে হবে। তাদের ধরে রাখতে পারলেই কোম্পানির নগদ প্রবাহ অব্যাহত থাকবে। সকল ক্রেতা একই গুরুত্ব বহন করে না। প্রকৃতপক্ষে বাজারজাতকরণ হচ্ছে লাভজনক ক্রেতা আকর্ষণ করা ও ধরে রাখার কলা। সাধারণ ক্রেতার জন্য কোম্পানি যা খরচ করে তা উঠে আসে কোম্পানির সর্বোত্তম ক্রেতাদের কাছ থেকে। আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী James V. Putten এর মতে সাধারণ ও সর্বোত্তম ক্রেতার অনুপাত খুচরা ব্যবসায় ১৬:১, রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় ১৩:১, এয়ারলাইন্সের ব্যবসায় ১২:১, হোটেল মোটেল শিল্প ৫:১। তারপরও কিছু ক্রেতার নিকট পণ্য বিক্রয় করে কোম্পানি লোকসান দিতেই হয়। সুপরিচিত “২০-৮০” নীতিতে বলা হয় কোম্পানির ৮০% মুনাফা আসে ২০% ক্রেতার নিকট থেকে। Sherden এই নীতিটা কিছুটা পরিবর্তন করে বলেছেন “২০-৮০-৩০” নীতির কথা। এই নীতিতে বলা হয় ৮০% মুনাফা আসে ২০% ক্রেতার নিকট থেকে তবে মুনাফার অর্ধেক নষ্ট হয়ে যায় নীচের দিকের ৩০% অলাভজনক ক্রেতার সেবা দিতে। এর অর্থ হচ্ছে সবচেয়ে অলাভজনক ক্রেতাদের তাড়িয়ে দিয়ে কোম্পানি তার মুনাফা বৃদ্ধি করতে পারে। এছাড়াও আরো দুটি বিকল্প করণীয় আছে: মূল্য বাড়ানো অথবা অলাভজনক সেবার খরচ কমানো,যা আমরা ইতিপূর্বেই (সংকটে মার্কেটিং-৩) আলোচনা করেছি। কিছু ক্রেতা থাকে যারা খুবই অনুগত কিন্তু অলাভজনক। মফস্বল শহরে অথবা গ্রামে হেটে এদের বেশি দেখা যায় চায়ের দোকানে সকালে বসে বিকেল পর্যন্ত, বিকেলে বসে গভীর রাত পর্যন্ত থাকে। বন্ধের দিন আড্ডা দেয়, অন্য কোন দোকানে যায় না। অন্য দোকানের খাবারও খায় না। এই দোকানেই বসে থাকে। দিনশেষে কেবলমাত্র চা আর সিঙ্গারা বাবত বিল আসে মাত্র ৩০ টাকা। এ ধরণের অনুগত ক্রেতার জন্য ভালো ক্রেতারাও চা দোকানে বা রেস্টুরেন্টে বসার সুযোগ পায় না। এরা দোকানে বসে থাকার কারণে ব্যবসায়ে ক্ষতি হয় বেশি। এ ধরনের অনুগত ক্রেতাদের যত দ্রুত বিদায় করা যাবে ততই মঙ্গল। সম্ভব হলে তাদেরকে প্রতিযোগীর পাশের রেস্টুরেন্টে পাঠানো যেতে পারে। সবচেয়ে বড় ক্রেতার নিকট থেকেই সবচেয়ে বেশি মুনাফা আসবে এটা নাও হতে পারে। বড় ক্রেতারা বেশি সেবা ও সর্বোচ্চ আর্থিক সুবিধা দাবি করে। ক্ষুদ্র ক্রেতারা পুরো দাম দিয়েও সর্বনিম্ন সেবা পায়,কিন্তু তাদের সাথে লেনদেনের খরচ বেশি হওয়ায় মুনাফার যোগ্যতা কমে যায়। মধ্যম আয়তনের ক্রেতারা ভালো সেবা পায়,পুরো দাম দেয় এবং প্রায়ই এরা সবচেয়ে লাভজনক ক্রেতা। এই সংকটের সময়ে নতুন বড় ক্রেতা ধরার জন্য ব্যস্ত না হয়ে মাঝারি সাইজের ক্রেতাদের দিকে নজর দিতে হবে।

অর্থনৈতিক সংকটের সময় বাজারজাতকরণ চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। বাজারজাতকরণ কোন ঐচ্ছিক বিষয় না। প্রধান ক্রেতা এবং অন্যান্যদের নিকট থেকে কোম্পানির জন্য আয় নিয়ে আসার এটি একটি আবশ্যকীয় “ভালো খরচ”(good cost)। এসময়ে ক্রেতাদের সাথে কথা বলার সময় কৌশলী হতে হবে। অস্থিরতার সময় ক্রেতার মনোভাবকে যারা সত্যিকারভাবে অনুধাবন করতে পারবে তারাই সফল হবে। ক্রেতারা সাশ্রয়ী হওয়ার প্রয়োজনে বিকল্প মূল্যায়নের জন্য বেশি সময় নিবে। সহজে প্ররোচিত হবে না। লোভনীয় অর্পণের বিপরীতে তাদের সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরবে। অর্পণের মধ্যে আর ‘কি সুযোগ আছে’ তা খতিয়ে দেখে প্রতিযোগী কোম্পানির অর্পণের সাথে তুলনা করতে সময় নিবে। উপস্থাপিত তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাইবে। তারা সঠিক পণ্য বা সেবাটিই পছন্দ করছে এ ব্যাপারে অধিকতর নিশ্চয়তা চাইবে। বিক্রেতাকে ক্রেতার প্রতি আরো বেশি সংবেদনশীল হতে হবে। এ সময়ে টানাটানিতে থাকা ক্রেতারা তাদের ভোগের তালিকা কাটছাঁট করবে। পরিবর্তিত অবস্থাতেও বিক্রেতার পণ্য বা সেবাটি কেন ক্রেতার কাটছাঁট করা তালিকায়ও স্থান পেতে পারে তা পরিষ্কার করে ক্রেতার সামনে তুলে ধরতে হবে।

ব্র্যান্ডের ক্ষয়ক্ষতি এখনো অজানা। ছোট এবং মাঝারি সেক্টর (SME) -এর ব্যাবসায় পড়তি ডাবল ডিজিট অতিক্রম করেছে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। যারা এ সংখ্যায় যুক্ত হতে চাইবে না তাদের মার্কেটিং কার্যক্রম জোরালো করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। ঘরবন্দী ক্রেতারা তাদের নীডের প্রতি সংবেদনশীল বার্তার প্রতি অধিক মনযোগী হয়।

বেকারত্ব ও অন্যান্য কারণে মানুষের আয় কমে যাওয়ায় “অল্প টাকার” জন্যও বিক্রেতাদের মধ্যে টানাটানি শুরু হবে। ক্রেতারা ডিজিটাল স্ক্রিনে এখন বেশি চোখ রাখে। ডিজিটাল মাধ্যমে তাদের সাথে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। বিনোদনের অংশ হিসেবে কোম্পানিকে তার পণ্যের পারফরম্যান্স তুলে ধরতে হবে। মনে রাখতে হবে দুর্যোগের সময় ব্র্যান্ডের চেয়ে ক্রেতারা পারফরম্যান্সের প্রতি বেশি সংবেদনশীল হয়। যারা বিজ্ঞাপন তৈরি করবে তাদের মনে রাখতে হবে এ সময়ে জনগণ আতঙ্কের মধ্যে থাকে। বিজ্ঞাপন নির্মাতাকে বুঝতে হবে কাদের উদ্দেশ্যে তাঁর বার্তা এবং কোন বিষয়টাকে জোর দিতে হবে, কারণ ইতোমধ্যেই অডিয়েন্সের নীড পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। এই মুহূর্তে অডিয়েন্সের সবচেয়ে অগ্রাধিকারের বিষয় হচ্ছে তার নিজের ও পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা। বাকি সবকিছু এখন পিছনে পড়ে গেছে। পণ্য বিক্রির জন্য করোনা-উত্তর কালে অনেক সময় পাওয়া যাবে। এসময়ে ক্রেতার বিপদে সহমর্মিতা প্রকাশ হবে যথাযথ অ্যাপ্রোচ। এ সময়ে ক্রেতারা আর্থিক সংকটে থাকে বিধায় অর্পণের আর্থিক প্রণোদনা ও সুবিধার প্রতি বেশি মনযোগী হয়। বিক্রেতাকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী স্টেকহোল্ডারদের জন্য কিছু করতে হবে। সকল ব্যাবসায়ী মন্দায় আক্রান্ত। ফুটপাতের চা দোকান থেকে এয়ারলাইনস পর্যন্ত প্রত্যেকেই তাদের মত করে সাঁতার কাটছে। তারপরও স্টেকহোল্ডারদের সাহায্য করার জন্য কোম্পানিগুলো কিছু না কিছু করছে। এই মুহূর্তে প্রয়োজন না থাকলেও কর্মী ছাঁটাই করছে না। সব কর্মচারীদের বেতন দিচ্ছে, সযত্নে ছুটি দিচ্ছে। অবশ্য কিছু কিছু ব্যতিক্রমও আছে। কোন কোন কোম্পানি তার কর্মীদেরকে কোন আর্থিক সুবিধা ছাড়াই বিদায় করে দিচ্ছে। অনেক কোম্পানি ত্রাণ ও স্বাস্থ্য সামগ্রী বিতরণ করছে। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা কোম্পানির ইমেজ বাড়াতে পুঁজি হিসেবে স্টেকহোল্ডারদের মনে সঞ্চিত হচ্ছে যা সুদিনে ভালো রিটার্ন দিবে।

ক্রেতারা মৌলিক পণ্যের প্রতি মনযোগী হবে। মানুষ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি রপ্ত করেছে। এটা বজায় রাখার জন্য উপযোগী অর্পণ নিয়ে যারা এগিয়ে আসবে তারা ভাল ব্যাবসায় করতে পারবে। রোগ সংক্রমণের ভীতি দূর করার দায়িত্ব ব্যাবসায়ীকে নিতে হবে। অনলাইন চ্যানেল খোলাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ব্র্যান্ডকে রিপজিশনিং এর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে ব্র্যান্ড ইমেজ পরিবর্তনেরও চেষ্টা করতে হবে এবং নতুন অবস্থানটি ক্রেতাদের সুনির্দিষ্ট করে জানিয়ে দিতে হবে।

ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য সুপারিশ হচ্ছে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া অলাভজনক ব্যবসায় ছারার এটাই সময়। এলাকার মানুষের চাহিদার পরিবর্তনটি ভালোভাবে অনুধাবন করে ব্যবসায় পরিবর্তন করতে হবে। একসময় সিনেমা হলগুলো “হাউসফুল” থাকতো। আমার মনে আছে স্বাধীনতার পরপর কুমিল্লার একটি সিনেমা হলে ‘সুয়োরাণী দুয়োরাণী’ সিনেমা দেখার জন্য দুই টাকার টিকেট ২০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছিল। উল্লেখ্য, আমাদের আমলে সিনেমাগুলোর নাম এমনই ছিল যেমন- বেহুলা সুন্দরী, রাজা সন্ন্যাসী, কাঞ্চনমালা ইত্যাদি। আজকের দিনে সিনেমার যে ধরনের নামকরণ করা হয় তা তখনও চালু হয়নি। ইদানীংকালে সিনেমার নাম দেখছি- ধর শালারে, পালাবি কোথায়, স্বামী কেন পলাতক, বাবা কেন আসামি ইত্যাদি। বেশিদিন সময় লাগেনি, সিনেমার বাজারে এমন পতন আসে বেশিরভাগ সিনেমা হল ভেঙে নতুন মার্কেট করা হয়েছে। সমস্যা হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার স্বাস্থ্য বিধান পালন করতে গিয়ে ওই আধুনিক মার্কেটেও ক্রেতা পাওয়া যাবে না। ওই মার্কেটগুলো ভেঙে বা সংস্কার করে ছোট ছোট এক কামরার বাসযোগ্য অ্যাপার্টমেন্ট হয়তো তৈরি করতে হবে। মধ্যমা বা স্বল্প বেতনের/ আয়ের একা থাকা লোকেরা যারা কয়েকজন মিলে, কখনো কখনো ১০/১৫ জন একসাথে, গাদাগাদি করে মেসে থাকে তাঁরা অন্য ব্যয় কমিয়ে হলেও এখন প্রত্যেকে আলাদা থাকতে চাইবে। এই স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টগুলো দ্রুতই ভাড়া দেওয়া যাবে বা বিক্রি করা যাবে। কারণ আইসোলেশন বা একা থাকার ব্যাপারটি আমাদের সংস্কৃতিতে আস্তে আস্তে সুদৃঢ় হবে।

মার্কেট নীচার’রা (nichers) বিশেষীকরণের উপর টিকে থাকে। কথায় আছে,”Key to nichemanship is specialisation”। একটা বিশেষায়িত সেবার চাহিদা কমে গেলে নতুন একটি বিশেষায়িত সেবার চাহিদা বেড়ে যায়। ছোট উদ্যোক্তাদের এই সুযোগটা নিতে হবে। অলাভজনক এবং ভবিষ্যৎ অন্ধকার যে ব্যবসার সেটাকে আঁকড়ে ধরে কান্নাকাটি না করে দ্রুত বিসর্জন দেওয়াই ভালো।
==================================

করোনার কারণে দীর্ঘস্থায়ী মন্দা, মন্দা সৃষ্ট বেকারত্ব, বেকারত্বের কারণে দারিদ্র্য এই চক্র মোকাবেলায় কোম্পানিগুলোকে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। মন্দার কারণে যেমন আয় কমবে তেমনি আয় বৈষম্যও তৈরি হবে। বিশেষ করে অনলাইনে কাজ করার কর্মদক্ষতার হেরফেরের কারণে ‘cyber poverty gap’ তৈরি হবে। আর্থ-সামাজিক এই পরিবর্তনকে আমলে নিয়ে যারা নীতি কৌশল সাজাতে পারবে তারাই টিকে যাবে। অনেক কোম্পানি নতুন প্রযুক্তি পরিবেশে অবাঞ্চিত হয়ে যাবে । কোভিড-১৯ পরবর্তী প্রযুক্তি ও দক্ষতা নির্ভর সমাজে বাজারজাতকরণের সেকেলে নীতি কৌশলগুলো ঢেলে সাজাতে না পারলে বাজারে টিকা যাবে না। আগেই বলেছিলাম সংকট মানে দুর্যোগ, তবে সুযোগও বটে। কারো জন্য সুযোগ কারো জন্য দুর্যোগ। করোনা রেস্টুরেন্ট ব্যবসার জন্য দুর্যোগ । যুক্তরাষ্ট্রে রেস্তোরাঁর বেচাকেনা ৬৬ শতাংশ কমেছে, কিন্তু গত মার্চ মাসে মুদি দোকানে ৭৭ শতাংশ বিক্রি বেড়েছে। অর্থাৎ মানুষ বাড়িতে রান্না করে খাচ্ছে। এই ধারাটি অনেকদিন অব্যাহত থাকবে। অতএব ঘরে রান্নার সহজ উপায় ও উপকরণের বাজার চাঙ্গা থাকবে। পাবলিক পরিবহন মানুষ পরিহার করতে চেষ্টা করবে। মার্চ মাসেই যুক্তরাষ্ট্রে বাইসাইকেল বিক্রি ৭০শতাংশ বেড়েছে। বরিশাল ময়মনসিংহ ও উত্তরবঙ্গ থেকে আসা আমাদের গৃহস্থালি সহায়ক মহিলারা বাড়িতে চলে যাচ্ছে, আর ফিরবে কিনা সন্দেহ। এতদিন অনেকেই কাজ না করিয়েও তাদের বেতন অব্যাহত রেখেছিল। কারণ ধারণা ছিল পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এই গৃহস্থালি কাজের সহায়ক মহিলারা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে, অতএব বিনা কাজে বেতন দিয়ে মালিকরা ‘বুয়াদের’ সাথে বন্ধন অটুট রাখার চেষ্টা করেছিল । কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ঘরের দৈনন্দিন কাজকর্মের জন্য বাইরে থেকে (বিশেষ করে বস্তি থেকে) আসা কর্মীদের আর নিরাপদ মনে হচ্ছে না। অতএব নিজেই রান্না করে খেতে হবে । এই সুযোগে বাজারে প্যাকেটজাত আধা প্রস্তুত খাবার এবং গুড়া মসলার চাহিদা বেড়ে যাবে। ওয়াশিং মেশিন, ডিশওয়াশার ,ওভেন , রাইস কুকার, প্রেসার কুকার,ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ইত্যাদি হাউজহোল্ড অ্যাপ্লায়েন্সেস এর বাজার চাঙ্গা হবে। McKinsey and Company নব্বইয়ের দশকে কোম্পানিগুলোর জন্য “Three Horizons Framework” সুপারিশ করেছিল । প্রথম horizon-এ থাকবে বর্তমান সময়ের বিদ্যমান সুযোগগুলো। এইগুলো ব্যবসায়ের core benefit. এগুলোকে ধরে রাখতে হবে এবং সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে। তবে পণ্যের জীবন চক্রের অবধারিত পথ মাড়িয়ে এগুলো একসময় আকর্ষণীয়তা হারাবেই। যার জন্য কোম্পানিগুলোকে দ্বিতীয় horizon অর্থাৎ ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সুযোগগুলোর কথা আমলে নিয়ে অনবরত উদ্ভাবনী চিন্তা করতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রবণতা ও সম্ভাবনাগুলো কোম্পানির অনবরত গবেষণার বিষয় হবে এবং নতুন নতুন উদ্ভাবনী ‘অর্পণ’ নিয়ে কোম্পানির তৈরি থাকবে।তৃতীয় horizon হচ্ছে বদলে যাওয়া পরিস্থিতিকে সৃজনশীলতা দিয়ে মোকাবেলা করা। অনিশ্চয়তা ও হঠাৎ করে আসা অজানাকে জয় করা। আকস্মিক সংকটের কারণে সৃষ্ট নতুন সুযোগগুলো গ্রহণের সৃজনশীলতার চর্চা করা। যদি ভবিষ্যতে অনিশ্চয়তা আসে, থমকে দাঁড়ায়, বা প্রতিবন্ধকতা কোম্পানির স্বাভাবিক অগ্রযাত্রাকে বিঘ্নিত করে তখনকার জন্য স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা প্রস্তুত রাখা। করোনার মত একটা প্যানডেমিক বিশ্বকে থমকে দেবে এটা হয়তো কোম্পানিগুলোর ভাবনার মধ্যে ছিল না। তবে যেকোনো আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট অনিশ্চয়তার জন্য কোম্পানিগুলো কন্টিনজেন্সি প্ল্যান তৈরি রাখে। যাদের এই ধরনের প্ল্যান ছিল তারা এই দুর্যোগের সময় ভালো ব্যবসা করবে। যাদের এধরনের পরিকল্পনা ছিল না তাদেরকেও সবকিছু স্থগিত রেখে তৃতীয় horizon নিয়ে কাজ করতে হবে। ২০২০ সালটা বা পরবর্তীতে দুই একটা বছর কিভাবে কোম্পানি টিকে থাকবে তার জবাব পাওয়া যায় বিশ্ব বিখ্যাত শিল্পপতি রতন টাটা’র সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকার থেকে। তিনি বলেছেন, “লাভ বা ক্ষতির হিসাব নিয়ে চিন্তা করবেন না। স্বপ্ন ও পরিকল্পনা নিয়েও দুশ্চিন্তা করবেন না। এই বছরটা শুধুমাত্র বেঁচে থাকাটাই লাভের সমতুল্য”। যেটা আমাদের দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড এসিআই ব্র্যান্ডের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর সৈয়দ আলমগীরও বলেছেন, “বেঁচে থাকলে একদিন মুনাফা হবে”। সম্প্রতি তিনি আরো বলেছেন, “বিশ্ব এখন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ব্যবসায় ক্ষেত্রে নতুন কৌশল নিতে হবে। মানুষের আয় কমবে। খরচের প্রবণতা কমবে। যারা এক কেজি করে কিনতো তারা আধা কেজি করে কিনবে। এমন অনেক কিছুই দেখা যাবে । এ সময় পন্যকে মানুষের উপযোগী করে সাজাতে হবে ।” কোম্পানিগুলোতে যারা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (CEO) হিসেবে থাকেন তারা সব সময় একই ধারণা পোষণ করেন না। মার্কেটিং এর প্রতি এদের দৃষ্টিভঙ্গিও বিভিন্ন রকমের হয়। মার্কেটিং এর প্রতি তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী কোম্পানিগুলোর CEO দের Philip Kotler চার ভাগে ভাগ করেছেন: 1P, 4P, STP, ME. 1P (CEO): এসকল কোম্পানি পণ্য ,মূল্য, বন্টন, অথবা প্রমোশন এর যেকোন একটাকে মার্কেটিং এর একমাত্র হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করে। এদের বিভিন্ন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি থাকে, যেমন- পণ্য ভালো মানের হলেই মানুষ কিনবে; কম দাম হলে কিনবে; হাতের কাছে পেলেই কিনবে; অথবা ‘চেষ্টা করলে বেচা যায় না’ এমন কিছু দুনিয়াতে নাই। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির প্রত্যেকটির প্রচন্ড ধরনের সীমাবদ্ধতা আছে । যেমন ভালো মানের সংজ্ঞা কে দিবে , ভালোমানের খরচ বহন করবে কে ? জিনিস কত দামী হলে মানুষ ভালো মনে করবে? কম দামে হলে মানুষ মান নিয়ে সন্দেহ করবে ? ইত্যাদি। তাছাড়া প্রতিযোগিতার বাজারে অন্যের চেয়ে কম দামে বিক্রির সুযোগ থাকেনা। হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তাই যদি মানুষ কিনতো তাহলে আমাদের প্রত্যেকের শ্বশুরবাড়ি পাশের বাড়িতই হত। আর, সারাক্ষণ সাধাসাধি-ঠেলাঠেলির মত বেহায়াপনা করে কিছু পণ্য বিক্রি করা গেলেও সব পণ্য বিক্রি করা যাবে না। 4P (CEO): তাঁরা বাজারজাতকরণ মিশ্রণের চারটা হাতিয়ারকেই সমান গুরুত্ব দেয় । ক্রেতাকে মধ্যখানে বা কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে তাদের পছন্দ এবং সামর্থ্য অনুযায়ী পণ্য,মূল্য, বন্টন, ও যোগাযোগ ব্যবস্থা নির্ধারণ করে। যেকোন একটি হাতিয়ারকে প্রাধান্য দিয়ে অন্যগুলো অগ্রাহ্য করে না। STP (CEO): তাঁরা টার্গেট মার্কেটিং করে। প্রথমে বাজারকে বিভক্ত করে নেয় । বিভক্ত বাজার খণ্ডগুলো থেকে তার জন্য আকর্ষণীয় এবং তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী বাজার খণ্ডটি বা খণ্ডগুলো নির্বাচন করে। এবং নির্দিষ্ট খন্ডের ক্রেতাদের মনে তাদের পণ্যের জন্য একটা অবস্থান (position) তৈরি করে। ME (CEO): তাঁরা মনে করে মার্কেটিংই সবকিছু, সর্বত্রই মার্কেটিং (marketing everywhere)। কোম্পানির একটাই কাজ ‘ক্রেতা ধরা এবং ধরে রাখা’ । কোম্পানির সবাই মিলে যাই করুক , উদ্দেশ্য একটাই- মার্কেটিং। সবকিছুতেই মার্কেটিং থাকতে হবে । আজকে আমরা “STP” দলভুক্ত কোম্পানির জন্য সংকটকালে মার্কেটিং কৌশল নিয়ে আলোচনা করব । প্রথম কাজটি হচ্ছে বাজার বিভক্তিকরণ (market segmentation)। যেহেতু প্রত্যেক ক্রেতার নিড এবং অভাব স্বতন্ত্র, প্রত্যেককেই সন্তুষ্ট করার জন্য একজনকে একটি পৃথক বাজার ধরে প্রত্যেকের জন্য একেকটি করে আলাদা বাজারজাতকরণ প্রোগ্রাম তৈরি করা যেতে পারে। যা হবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল। অন্যদিকে সমস্যা হচ্ছে মানুষকে ভাগ করা যায় না। ভাগ করলেও প্রত্যেক ভাগে একজন করে মানুষ পড়বে। প্রত্যেকের DNA ম্যাপ ভিন্ন হওয়ায় দুইজন মানুষের মধ্যে সম্পূর্ণ মিল হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। কোথাও যদি দুইজনের মধ্যে পরিপূর্ণ মিল দেখা যায় বুঝতে হবে তাদের অন্তত একজন অপর জনের কাছে অথবা দুজনেই পরস্পরের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। কাজেই পূর্ণাঙ্গ (individual) বিভক্তিকরণ কার্য উপযোগী নয়। যদিও প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে অনেক কোম্পানি এমনটাই করার চেষ্টা করছে। Individual marketing প্রক্রিয়াটি জটিল ও ব্যয়বহুল বিধায় বাজারকে বিভক্ত করে সে অনুযায়ী বাজারজাতকরণ মিশ্রণ তৈরির প্রক্রিয়াটি এখনো সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য । ভালো সময়ের বাজার বিভক্তিকরণ চলকসমূহ দুর্দিনে ততটা কার্যকর নয় । আবার সুসময় আসলে, মন্দা পরবর্তী সময়ে ভোক্তা বাজার বিভক্তিকরণের সনাতন চলকগুলোর চর্চা করা যাবে। মন্দার সময়ের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই বাজার বিভক্তিকরণের চলক নির্ধারণ করতে হবে। মন্দার কারণে কর্মহীনতা মানুষকে দরিদ্র করবে এবং অনিশ্চয়তার কারণে মনের মধ্যে দারিদ্র্য ভাব জাগ্রত হবে । ফলে কম খরচ করতে চাইবে। তারপরও বেচাকেনা তো থেমে থাকবে না। যাদের যৎসামান্য সামর্থ্য থাকবে তা দিয়েই তাদের আবশ্যকীয় এবং আরাধ্য পণ্য ও সেবাগুলো কিনবে। যাদের সামর্থ্য একেবারেই থাকবে না তাদের নিয়ে মার্কেটিং বইয়ে কোনো আলোচনা নেই। এটা সমাজকর্ম বিভাগের কাজ, পুরোটাই non-profit marketing. যাদের হাতে টাকা থাকবে তাদের চার ভাগে ভাগ করতে হবে: (১) দরিদ্র ক্রেতা: যারা অত্যন্ত অল্প খরচে জীবন যাপন করবে। করোনার প্রভাবে তাদের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক হবে । তারা খরচ কমাবে , কেনা বাদ দিবে, স্থগিত করবে বা কম কিনবে; অথবা কম দামে বিকল্প জিনিস দিয়ে প্রয়োজন মেটাবে। দরিদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্তরা এই শ্রেণীতে পড়বে। ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার আতঙ্কে আতঙ্কিত হয়ে কিছু মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত লোকেরাও এই ধরনের আচরণ করতে পারে। (২) আতঙ্কিত কিন্তু ধৈর্যশীল ক্রেতা: এই শ্রেণীর ক্রেতারা জানে কোন মন্দায়ই চিরদিন থাকে না। চলতি মন্দাবস্থা দীর্ঘদিন থাকবে না। তবে সহসা কোন ভাল অবস্থাও দেখছেন না। দরিদ্র শ্রেণীর ক্রেতাদের মত তারাও সাশ্রয়ী হতে চাইবে। তবে আগ্রাসী ধরনের কিপ্টেমি করবেনা। এদের সংখ্যাই বেশি হবে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বেকার হওয়ার আতংকে থাকবে তাঁরা। তাঁদের মধ্যে ব্যাপক আয় বৈষম্য তৈরি হবে। বিশেষ করে cyber poverty gap তৈরির কারণে। সংস্পর্শে না এসে দূর থেকে কাজ করার প্রযুক্তি যারা রপ্ত করতে পারবে বা ব্যবহার করতে পারবে তাদের আয় বেড়ে যাবে। অন্যরা পিছনে পড়ে যাবে। (৩) ধনীক শ্রেণী: এরা তুলনামূলকভাবে অবস্থাসম্পন্ন ক্রেতা। তাঁরা করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলার সামর্থ্য রাখে। অর্থনৈতিক পড়তি অবস্থাতেও নিজের অবস্থান বজায় রাখার ব্যাপারে নিশ্চিত থাকে। তাদের ভোগে তেমন কোন পরিবর্তন হবে না। আগের মতই ভোগ করবে। তবে তাঁদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়বে। তরতাজা সবজি, ফল, মাংস , প্রোটিন-ভিটামিন সচেতন হবে। এসময়ে তারা কেনাকাটার সময় আগের চেয়ে বেশি বাদ-বিচার করবে। সর্বোচ্চ শ্রেণীর ১০% জনগোষ্ঠী এই শ্রেণীভুক্ত। তবে অত ধনী নয়, কিন্তু সংকটকালীন সুযোগ গ্রহণ করে ভবিষ্যতে অর্থশালী হওয়ার যাদের সুযোগ আছে তারাও এই শ্রেণীভূক্ত হবে। (৪) এক দিনের জন্য বেঁচে থাকা শ্রেণি (live for today): এই শ্রেণীটির জীবনে কাল ( tense) একটিই – বর্তমান । তাদের অতীত ও ভবিষ্যত নেই । অতীতের কথা মনে রাখে না ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবে না । এই ধরনের ক্রেতারা আগের মতই চলবে। তাঁরা সঞ্চয়ের ব্যাপারে মনোযোগী হয় না। ভবিষ্যৎ সৃষ্টিকর্তার হাতে। যতক্ষণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ বেকার হয়ে সরকারি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর জালে গিয়ে না আটকাবে ততক্ষণ তারা আগের মতই খরচ করবে। তারা তাদের ক্রয় আচরণ পরিবর্তন করবে না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ চরম সংকটে পড়লেও তা সহসাই কেটে যাবে এই ভরসায় সুযোগ থাকলে ধার-দেনা করে হলেও আগের মতই খরচ করবে। কোম্পানিগুলোকে তাদের বাজার বিভক্তিকরণের জন্য ব্যবহৃত সনাতন চলকসমূহকে কম গুরুত্ব দিয়ে সংকটের সময় উপরোক্ত চারটি শ্রেণীতেই ভোগ্য পণ্যের ক্রেতাদের ভাগ করে তাদের পরিবর্তিত প্রত্যাশা, সামর্থ্য ও আচরণ পর্যালোচনা করে নিজেদের “অর্পণ” তৈরি করতে হবে। সনাতনী পণ্য নিয়েও বসে থাকা যাবে না। যার ফলে দেখা যাচ্ছে ফ্যাশন হাউসগুলো মাস্ক বানাচ্ছে, অটোমোবাইল ও ইলেকট্রনিক্স কোম্পানিগুলো ভেন্টিলেটর বানাচ্ছে, পারফিউম কোম্পানির সবচেয়ে চালু পণ্য হচ্ছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার।
=========================================

মার্কেটিং সংশ্লিষ্টদের একটা বিষয় মনে রাখতে হবে ‘now normal’ অবস্থায় “people are in browsing mode, not in buying mode”. যতটা সম্ভব বেশি বিক্রি করার চেষ্টা না করে ক্রেতাদের মনে কোম্পানি বা ব্র্যান্ডের অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করাই এই সময়ের প্রধান কাজ। ক্রেতাদের ঘরে থাকার (stay home) বিষয়টার তাৎপর্য অনুধাবনের চেষ্টা করতে হবে। ক্রেতাদের ঘরে থাকার তাৎপর্য হচ্ছে তাদের সামাজিক মাধ্যমে যোগাযোগ বেড়েছে। ‘Statista’ এর সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে COVID-19 এর কারণে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার ৪০% বা তারও বেশি বেড়েছে, কিন্তু নতুন কনটেন্ট আপলোড হওয়ার পরিমাণ বেড়েছে মাত্র ১৪% । এর অর্থ হচ্ছে মানুষ বেশি দেখছে; বলছে না বা দেখাচ্ছে না। আপনার ব্র্যান্ড নিয়ে যদি কিছু বলার থাকে, সত্যিই যদি থাকে, তাহলে আজই বলুন। তবে মনে রাখবেন এই চেষ্টার ফলে অতি দ্রুত আপনার বিক্রি বাড়বে না। ক্রেতার মনে অবস্থান ধরে রাখুন। ‘নিউ নর্মাল’ (new normal) আসলে এটা কাজে লাগবে। ‘Now normal’ এর সময় কিছু কিছু কোম্পানি ভাল করছে। এটা আপাতত সত্য, নিত্য সত্য নয় । কখনো ভাববেন না ‘we are safe, it would not happen to us’. মন্দা এক পর্যায়ে কাউকে ছাড় দিবে না । আর একটা কথা বলছি, সবকিছু ই-কমার্স বা অনলাইন হয়ে যাবে বলে যারা মনে করছেন; দুঃখজনক হলেও সত্য, সেটাও হবে না। নগদের প্রতি মানুষের প্রচন্ড আকর্ষণ আরো অনেকদিন অটুট থাকবে বলেই মনে হয়। সুইজারল্যান্ড ক্যাশবিহীন (cashless) হওয়ার জন্য প্রায় এক যুগ ধরে চেষ্টা করেও সম্পূর্ণ সফল হতে পারেনি। দরিদ্র এবং cyber poverty gap -এ পড়ে যাওয়া জনগোষ্ঠীকে ‘নগদ পাওয়া’ বা ‘হাতেনাতে দেখে পাওয়ার’ আকর্ষণ থেকে বের করে আনা সহজ হবে না । এমনকি শিক্ষিত ও সাইবারে যুক্ত ব্যক্তিরাও নগদ ও হাতেনাতে পেতে বেশি পছন্দ করে। প্রত্যেক বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময় পরীক্ষার দিন পরীক্ষার হলে দায়িত্ব পালনের জন্য শিক্ষকদের সম্মানী নগদে প্রদান করা হয় । এ বিশাল কর্মকাণ্ডের জটিলতা পরিহারের জন্য আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার ভর্তি পরীক্ষার সময় পরীক্ষার হলে ঘুরে ঘুরে নগদ টাকা বিতরণ না করে এক দুই দিন পর অনলাইনে পরিদর্শকদের সম্মানীর টাকা ব্যাংক হিসাবে পরিশোধের প্রস্তাব দিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০% শিক্ষক টাকাটা ওইদিনই হাতে হাতে নগদ পেতে আগ্রহী বলে জানিয়েছিল । আপনার পণ্যটি অনলাইনে দেখে ক্রয় করার প্রক্রিয়ার অনেকগুলো কাজেই তারা হয়তো সম্পন্ন করবে। কিন্তু ‘ট্রায়াল’এবং ‘ক্রয়’ এ দুটি কাজ ‘নিউ নর্মাল’ কালেও তারা আগের মতই হাতেনাতে করতে চাইবে। Now normal এর কি কি বিষয় ‘New Normal’ এ স্থিতু হবে বা স্থায়িত্ব পাবে এটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। Now normal এর ফ্যাড (fad- হঠাৎ এসে হঠাৎ চলে যাওয়া) ফ্যাশনে বা স্টাইলে রূপান্তরিত হবে কিনা বলা মুশকিল। দীর্ঘদিন মানুষ মাস্ক পড়বে কিনা সন্দেহ। ইতিমধ্যেই অনেক বিশেষজ্ঞ বলতে শুরু করেছেন মাস্ক মানুষের শরীরে অক্সিজেন স্বল্পতা তৈরি করে। অতি আবশ্যক না হলে এটা পরিহার করাই ভালো। এতে লিপস্টিক বা প্রসাধনী প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর হাত আছে কিনা তা এখনই বলা যাবে না। তবে লিপস্টিক বা প্রসাধনী উৎপাদনকারী শক্তিধর বহুজাতিক কোম্পানিগুলো হাল ছেড়ে দেবে এটা ভাবার কোন কারন নাই। মানুষ বেশিদিন তার প্রিয়জনদের স্পর্শ না করে থাকবে বলেও মনে হয় না। স্পর্শ ছাড়া পরস্পরের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে কি করে? মানুষ অনেক দিন আইসোলেশনে একঘরে হয়ে থাকতে চাইবে না। মানুষ হচ্ছে মৌমাছি আর সিংহের মাঝামাঝি স্বভাবের প্রাণী। মানুষ হয়তো মৌমাছির মত প্রচন্ড সঙ্ঘবদ্ধ হবে না ; আবার সিংহের ন্যায় একা একাও থাকতে চাইবে না। অতিসম্প্রতি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেখানে লকডাউন তুলে নেয়া হয়েছে সেখানে মানুষকে আবার অনেক ক্ষেত্রেই আগের রূপে দেখা যাচ্ছে। আইনের কঠোরতা ও জরিমানার ভয় না থাকলে পশ্চিমা দুনিয়ার কেউই ‘Now normal’ এর স্বাস্থ্যবিধি ‘New Normal’ এ মানবে বলে মনে হয় না । আমাদের দেশে পুলিশ-মিলিটারির সাহায্য নিয়েও মানুষকে নতুন নিয়ম মানানো যাচ্ছে না। একই শিরোনামের আগের লেখাগুলোতে ‘New Normal’ এর প্রতি দৃষ্টি দেয়া হয়েছিল। আজকের লেখাটির বিষয়বস্তু ‘Now Normal’ কেন্দ্রিক। করোনা ভোক্তাদের দুর্দশায় ফেলেছে। তাদের আচরণ বদলে যাচ্ছে, ক্রেতারা কোথায় কিভাবে ব্যয় করবে তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করছে। অডিয়েন্স আগের অবস্থায় নেই । নতুন ধরনের প্রতিযোগিতা তৈরি হচ্ছে। এগুলো সবই বর্তমানের বাস্তবতা। এই বাস্তবতার ‘Now normal’ এ আমাদের অনেক দিন কাজ করতে হবে। বর্তমান অবস্থায় এই মুহূর্তে ব্যবসায় কিভাবে টিকে থাকবে এই বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েই আজকের আলোচনা। এসময় প্রধান কাজটি হচ্ছে তাদের কোম্পানির অর্পণকে(offering) কষ্টিপাথর দিয়ে পরখ করে মৌলিক পণ্যে ফিরে আসা : ১ । কোম্পানির অর্পণটি যার বা যাদের জন্য সে বা তাঁরা কি পরিবর্তিত হয়েছে? ২ । অর্পণের সুবিধাগুলো কি, এগুলো কি এই সংকটের সময় ক্রেতার নিকট তাৎপর্যপূর্ণ? ৩ । অর্পণটি ক্রেতার মনে কি ধরনের অবস্থান(position) পেয়েছিল ? এই অবস্থানটিতে ক্রেতার বর্তমান নীডের প্রতিফলন হচ্ছে কি? ৪। এখনো কেন অর্পণটি তাৎপর্যপূর্ণ ? অস্থিরতার সময় মানুষের দৃষ্টি ‘আবশ্যকীয়তার’ প্রতি নিবদ্ধ হয়। এই বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন পড়তি অবস্থায় মার্কেটিং এর কর্মকৌশল বদলালেও মৌলিক নীতিমালা অপরিবর্তিত থাকে। মার্কেটিং সংজ্ঞাগত ভাবে পুরোটাই “সঠিক দামে, সঠিক স্থানে, সঠিক পণ্যটির সাহায্যে ক্রেতার নীড পূরণ করা এবং এর মধ্য দিয়ে লাভ করা”। অর্থনীতির উঁচু টান(upswing) এর সময় মার্কেটিং এর দৃষ্টিভঙ্গি থাকে দীর্ঘ মেয়াদী, মুনাফা সর্বোচ্চকরণ। এক্ষেত্রে বাজারজাতকরণকে বিনিয়োগ হিসেবে দেখা হয়। মার্কেটিং এর পরিসর থাকে ব্যাপক, মার্কেটিং এর লোকেরা মুনাফা দ্বারা তাড়িত হয় এবং সুযোগের এর প্রতি প্রোএকটিভ হয় । অপরদিকে অর্থনীতির যখন নিচুটান (recession) থাকে তখন মার্কেটিং এর দৃষ্টিভঙ্গি হয় স্বল্পমেয়াদী। খরচ সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। এসময়ে বাজারজাতকরণকে একটি খরচ হিসেবে দেখা হয়। মার্কেটিংয়ের লোকজন খরচ ও বিক্রয় তাড়িত হয়ে রিএকটিভ আচরণ করে। মার্কেটিং-এ ‘গেরিলা মার্কেটিং’ (Guerrilla Marketing) কথাটি অনেক দিন থেকে প্রচলিত। আদতে এটি একটি বিজ্ঞাপনী কৌশল। অডিয়েন্সকে বিমোহিত (surprise) করার জন্য প্রথার বাইরে গিয়ে কিছু করা। Jay Conrad Levinson ১৯৮৪ সালে “Guerrilla Marketing” শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করেন। রেডিও টেলিভিশন এবং ডাকযোগের মত সনাতনী বিজ্ঞাপনী মাধ্যমগুলোর জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার প্রেক্ষিতে ভোক্তাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগের কতগুলো কৌশল এই কাজে ব্যবহারের সুপারিশ করেছেন। যেমন রাস্তার উপর অঙ্কিত অথবা লেজার প্রতিবিম্ব দ্বারা সৃষ্ট পণ্যের প্যাকেটের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া। নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে গেলে কোন না কোনভাবে পথচারীকে গেরিলা আক্রমণের শিকার হতে হবে। প্রায় বস্ত্রহীন মহিলার গায়ে কোন পণ্যের Logo এঁকে ঘুরে বেড়ানো এধরনের গেরিলা আক্রমণের (আকর্ষণের) উদাহরণ। ‘গরিলা মার্কেটিং’ ( Gorilla Marketing) হচ্ছে একটি দল ভিত্তিক বোর্ড গেইম। এখানে অংশগ্রহণকারীদের সৃজনশীলতাকে পুরস্কৃত করা হয় । এতে রেডিকুলাস কিছু পন্য,সিনেমা ,কোম্পানি, ব্র্যান্ড, কলেজ কোর্স,খাবারের নাম দেয়া হয় এবং এসবের সাথে স্লোগান, বাক্য, চিত্র, ড্রইং ইত্যাদির সংমিশ্রণের সৃজনশীলতা অনুযায়ী খেলোয়ারদের পুরস্কৃত করা হয়। আমরা আজকে ‘বানর মার্কেটিং’ ( Monkey Marketing) এর কথা বলব। “Agile Marketing” এর এই বাংলা নামটি আমি সুপারিশ করছি। Agile এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘সহজে দ্রুত move করা’। Agile এর প্রতিশব্দের (synonym) সংখ্যা অসংখ্য (যেমন: active ,quick, lively, swift, brisk, supple, sprity, lithe, limber, spray, sharp, bright, prompt, alert, clever, quick-witted, dynamic, smart, apt)। এসকল গুণবাচক শব্দের সবকটি পর্যালোচনা করে আমার মানসে বানরের ছবিটি ফুটে উঠেছে। ‘গেরিলা’, ‘গরিলা’ এই দুটো মার্কেটিং এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে “Monkey Marketing” শব্দ গুচ্ছ চয়ন করলাম। Agile মার্কেটিং সফটওয়্যার নির্মাতাদের কাছে অনেক জনপ্রিয়। সফটওয়্যার নির্মাতাদের তাদের ক্লায়েন্টদের পরিবর্তনশীল প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতি রেখে অনবরত সফটওয়্যার আপডেট করতে হয়। Agile মার্কেটিং এর মূল কথাই হচ্ছে পরিবর্তনের সাথে ঝটপট সাড়া দেয়া। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুত অবস্থান পরিবর্তন করা। যেমনটি করে বানর। বানর প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে অথবা প্রতিপক্ষের আক্রমণ ঠেকাতে এ কাজটি করে থাকে। এমনকি বানরকে খাবার দিলে সে এক জায়গায় বসে খায় না । এক দুইটা জায়গা বদল করে তারপরে খায়। সফটওয়্যার ব্যবসায়ীদের অনবরত অবস্থান পরিবর্তন করতে হয় । ব্যবহারকারীদের অস্বস্তি দূর করা, তথ্য উপাত্ত যাচাই করা এবং ছোট ছোট পরীক্ষা-নিরীক্ষা অব্যাহত রাখা Agile মার্কেটিং এর বৈশিষ্ট্য। নতুন আইডিয়া জোগাড় করা, বাছাই করা, আইডিয়াকে কনসেপ্টে রূপান্তর করা, এর জন্য মার্কেটিং কৌশল নির্ধারণ করা, আর্থিক সম্ভাব্যতা বিশ্লেষণ করা, অর্পণ তৈরি করা, বাজার যাচাই করে তা বাণিজ্যিকীকরণ এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ । পুরো কাজটা করা হয় ব্যবহারকারীর সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে । সবশেষে, পারস্পরিক সহযোগিতার উপরেই ক্রেতা সন্তুষ্টি এবং কোম্পানির মুনাফা নিশ্চিত হয়। পরিবর্তনশীল চাহিদার সাথে তালে তালে নেচে চলতে হয় Agile মার্কেটিং চর্চাকারীদের। এর অন্যতম একটি সূত্র হচ্ছে অনবরত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসময়ের জন্য সঠিক জিনিসটি নিশ্চিতকরণ। উৎপাদন ও অর্পণকে পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানো এবং উন্নত যোগাযোগ Agile মার্কেটিংকে সম্ভব করে তোলে। Agile মার্কেটিং এর তিনটি ধাপ: পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, খাপ খাওয়ানো এবং অনবরত মানোন্নয়ন। এই পথ চলা কখনো থামে না। Agile ফ্রেমওয়ার্কে তিনটি উপাদান থাকে: Scrum, Kanban, Spotify. এই তিনটি উপাদানের নামে তিনটি কোম্পানিও আছে। Scrum হচ্ছে রাগবি খেলার যে হাফ ব্যাক বলটি হুটপটের মধ্যে ছুঁড়ে মারে। Agile মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে নতুন ধারণাটি একটি টিমের কাছে ছুঁড়ে মারা হয় । সংশ্লিষ্ট সবাইকে চিন্তা করে ফিডব্যাক দিতে বলা হয়। সবাই মিলে সমস্যাটি নিয়ে চিন্তা করে এবং ঘন ঘন মিটিং করে কখন কি করতে হবে তা ঠিক করা হয়। Kanban হচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়াকে এমনভাবে সিডিউল করা যাতে যথাসময়ে ডেলিভারি ( just -in- time) নিশ্চিত করা যায়। Taiichi Ohno, একজন জাপানি শিল্প-প্রকৌশলী এই পদ্ধতির উদ্ভাবক। জাপানি টয়োটা কোম্পানি তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় দক্ষতার জন্য এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করে এবং জাস্ট-ইন-টাইম ডেলিভারি নিশ্চিত করে । ব্যবহারকারীর প্রয়োজনের সাথে খাপ খাওয়ানোর প্রচেষ্টা হিসাবে সময় কমিয়ে এনে বেশি কাজ করাই এই সমন্বিত পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য। Kanban পদ্ধতিতে কর্মীদের কাজ শুরু করার চেয়ে কাজ শেষ করায় বেশি উদ্বুদ্ধ করা হয়। Spotify বিশ্ব বিখ্যাত মিউজিক কোম্পানি । দলগত সম্মিলিত প্রয়াসে অসাধারণ একটি সঙ্গীত জগত সৃষ্টি করেছে। কোম্পানিটি পরিবর্তনের ব্যাপারে খোলামেলা এবং পরিবর্তনের সাথে যথাযথভাবে খাপ খাওয়াতে অভ্যস্ত কর্মীদেরকে ছোট ছোট স্কোয়াডে বিভক্ত করে ক্রস-ফাংশনাল টিম তৈরি করা হয় এবং তাদেরকে একটি মিনি স্টারট-আপ অনুভূতি নিয়ে কাজ করতে বলা হয়। এই টিমটি স্বায়ত্তশাসিত ও স্বনিয়ন্ত্রিত হয়। এই টিমে সাধারনত ৫ থেকে ৭ জন সদস্য থাকে, তবে ১০ জনের কম হয়। এক অদৃশ্য সংস্কৃতি তৈরি করে তাঁরা সেটাকে সকলের অনুধাবনের মধ্যে নিয়ে আসে। সবাই নিয়মের মধ্যে থাকে কিন্তু তাঁরা সবাই জানে কখন গদবাধা নিয়ম থেকে বেরিয়ে যেতে হয়। কোম্পানির সবাই মিলে সহযোগিতার মাধ্যমে কার্যসম্পাদন সর্বোচ্চকরণের চেষ্টা করে। Spotify বিশ্বাস করে হাত গুটিয়ে রাখা বন্ধ করতে হবে। উপরের নির্দেশ এর জন্য কোন কাজ বন্ধ রাখা যাবে না । সবাইকে ভালো নাগরিক হতে হবে। কোম্পানির মিশন সফল করার জন্য সবাইকে একযোগে নামতে হবে। স্ব-সচেতনতা বাড়াতে হবে। যার মধ্য দিয়ে বিশেষ পরিবেশে ব্যক্তি নেতায় পরিণত হবে । তবে সবকিছুর কেন্দ্রে ক্রেতাকে রাখতে হবে। Agile মার্কেটিং বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে সবচেয়ে উপযুক্ত পদ্ধতি হতে পারে। এর মধ্য দিয়ে কোম্পানির সম্পদ ও মেধার অপচয় রোধ করা যায়। অনবরত মানোন্নয়নের মাধ্যমে কাস্টমারদের সার্বিক অভিজ্ঞতার উন্নয়ন সম্ভব। আর এর মধ্য দিয়েই কোম্পানির ইকুইটি এবং আয় বাড়ানো যেতে পারে।
=====================================
বাজার অর্থনীতির মূল প্রবক্তা অ্যাডাম স্মিথ(১৭২৩-১৭৯০) ” homo economicus” বা “economic man” তত্ত্বের জনক। ১৭৫৯ সালে প্রকাশিত তাঁর “The theory of moral sentiments” বইয়ে অর্থনৈতিক মানুষের ধারণার সূচনা করেন। মানুষ কেবলি “অর্থনৈতিক মানুষ”, এটা মানুষ সম্পর্কে খন্ডিত ধারণা বলে এর প্রচুর সমালোচনা আছে। তারপরও এ ধারণার সমর্থকের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। উনিশ শতকের দার্শনিক Rene’ Descarts, Gottfried Wilhelm, Jeremy Bentham থেকে John Stuart Mill পর্যন্ত অনেকেই “অর্থনৈতিক মানুষ” ধারণার সমর্থক ছিলেন । Economic man তত্ত্বে মানুষের যে বৈশিষ্ট্যগুলোকে তুলে ধরা হয় তা হল- মানুষ আগাগোড়া যোক্তিক, মোটামুটি স্ব-স্বার্থে তাড়িত এবং সে ব্যক্তিগত ব্যাখ্যাকে কাম্য(optimum) ব্যাখ্যা হিসাবে দাঁড় করাতে চায়। পরিপূর্ণ জ্ঞান নিয়ে সে সবসময় উপযোগ বা সন্তুষ্টিকে সর্বোচ্চ করতে চায়। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ আলফ্রেড মার্শাল (১৮৪২-১৯২৪) যিনি প্রান্তিক উপযোগ ও ভোক্তার উদ্বৃত্ত তত্ত্বের জনক তিনিও ‘অর্থনৈতিক মানুষ’ তত্ত্বকে সমর্থন করেন। মার্শালের বক্তব্য ছিল cost-benefit বিশ্লেষণ না করে মানুষ কিছু করে না । ব্যবসায়ীরা যেমন ‘রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট’ বা ROI হিসাব করেই ব্যবসায় নামে তেমনি পণ্যের মূল্য এবং প্রাপ্তব্য সুবিধার একটা তুল্য বিচার না করে মানুষ কোন কিছু কিনে না। (‘রিটার্ন অনইনভেস্টমেন্ট’এর বাংলা বলেছিলাম “কত ধানে কত চাল “। এরচেয়ে ভালো বাংলা কেউ বলতে পারলে সেটা গ্রহণ গ্রহণ করে নিব। ‘স্টেকহোল্ডার’ এর আমার সুপারিশকৃত বাংলা হচ্ছে- ‘যাদের যায় আসে’। এটারও একটা ভালো বাংলা শব্দের জন্য পাঠকদের প্রস্তাব আহবান করছি।) মন্দার সময় কি পণ্য কত দামে বিক্রি হবে এই প্রশ্নের জবাব আলফ্রেড মার্শালের ইকুইলিব্রিয়াম তত্ত্বে(equilibrium theory) পাওয়া যায় । মূল্য ও উৎপাদন চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য দ্বারা নির্ধারিত হয়। এক্ষেত্রে চাহিদা ও যোগানের স্থিতিস্থাপকতার বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সংকট মোকাবেলায় উপরের দার্শনিক আলোচনাটি প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছি। ক্রেতারা বিলাসিতা পরিহার করছে বা করতে বাধ্য হচ্ছে। আবশ্যকীয়তা তাদেরকে প্রধান বিবেচ্য হিসাবে স্থান পাচ্ছে। মূল্য সাশ্রয়ী ব্র্যান্ড এবং জেনেরিক পন্যের দিকে ঝুঁকছে ক্রেতারা। বিদেশি দামি পণ্য বাদ দিয়ে দেশী বিকল্প পণ্য খুঁজছে।অপেক্ষাকৃত ছোট প্যাকেট বা লট এখন তাদের পছন্দ। পণ্যের জীবন চক্র খরচ, স্থায়িত্ব এবং অর্থের বিপরীতে প্রাপ্ত ‘ভ্যালু’ ক্রেতারা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বিবেচনা করছে। বিনামূল্যে পাওয়া উপহারের প্রতি এ সময়ে কোনো আকর্ষণ থাকে না। কল্পনা ভিত্তিক আবেগীয় বিজ্ঞাপনের চেয়ে তথ্যভিত্তিক যৌক্তিক আবেদনময়ী বিজ্ঞাপনের প্রতি তাদের আগ্রহ বেশি থাকে। করোনার তীব্রতা কমে গেলেও মানুষের কাজ বাড়বে না। বেশি সময় হাতে থাকবে অথচ আর্থিক টানাটানির কারণে বিনোদনের ব্যয়বহুল পদ্ধতিগুলোর দিকে তাঁরা যেতে পারবে না। তখন বিনোদনের একটা মাধ্যম হবে “উইন্ডো শপিং” । বাজারে ঘুরে ঘুরে জিনিসপত্র দেখা, কেন নয়। কেনার সময় ডিসকাউন্ট দেয়া দোকান বা বাড়ির পাশের দোকান থেকেই জিনিস কিনবে। লোভনীয় পণ্যের( ইম্পালস প্রোডাক্ট) বিক্রয়, দোকান বা বাজার থেকে বের হওয়ার সময় শেষ মুহূর্তে চোখে পড়া পণ্যের ক্রয় কমে যাবে। মন্দার সময় ক্রেতার পরিবর্তনগুলোকে আমলে নিয়ে বাজারজাতকরণ মিশ্রণ সাজাতে হবে। দুর্বল বাজার অংশ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যে বাজারে কোম্পানির ব্র্যান্ডের শক্তিশালী অবস্থান আছে সেখানেই অবস্থান আরো শক্তিশালী করতে হবে। সুযোগ থাকলে দুর্বল প্রতিযোগীর ব্যবসায় ক্রয়ের এটা খুব ভালো সময়। স্থায়ী পণ্যের ক্ষেত্রে ক্রেতারা পণ্যের ‘রিসেল ভ্যালুর’ প্রতি বেশি মনোযোগী হবে। এটাকে পণ্য ক্রয়ের যৌক্তিকতা হিসাবে ক্রেতার সামনে তুলে ধরতে পারলে কাজ দেবে।
দুর্বল পণ্য বাতিল করারও এটা সবচেয়ে ভালো সময়, তবে এ সময়ে শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য নতুন পণ্য বাজারে ছাড়া বোকামি হবে। প্রয়োজনে ‘ফাইটিং ব্র্যান্ড’ বাজারে ছাড়তে হবে যা ক্রেতার ও প্রতিযোগিতার পরিবর্তনের সাথে বাজারে অবস্থান করে নিতে পারবে। কেউ কেউ দ্বিতীয় সারির ব্র্যান্ডকে সামনে আনার পরামর্শ দেন। অনেকটা স্ট্রাইকারদের গোল করার ব্যর্থতা দেখে ফুটবলের কোচ যেমন ব্যাক লাইনের খেলোয়ারদের বা ডিফেন্ডারদের সামনে পাঠায় গোল করার জন্য। কলম্বিয়ার ফুটবল টিমের গোলকিপার Rene’ Higuita (El Loco) কে প্রতিপক্ষের গোলপোস্ট পর্যন্ত গিয়ে গোল করতে দেখা গেছে। এই গোলকিপারের আন্তর্জাতিক মানের ফুটবল খেলায় গোলের সংখ্যা ৪১টি।
ব্র্যান্ডগুলোকে পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষিতে তাদের অবস্থান ব্যাপক অভিযোজন করে নিতে হবে। সহজ সরল এবং অপেক্ষাকৃত টেকসই পণ্যের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। পণ্যের অতিরিক্ত অংশ (augmented product) হিসেবে ওয়ারেন্টি(warranty) এ সময়ে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হতে পারে। ক্রেতার নিকট দাম স্থির রেখে মান বাড়ানো গেলে সবচেয়ে ভালো । মূল্য কমালেও মান বজায় রাখতে হবে । মান এবং দাম একসাথে কমানোর কৌশল এই মুহূর্তে পরিহার করাই ভালো। পণ্যের জীবন চক্র মূল্য কৌশল কার্যকর করতে হবে।
বিজ্ঞাপনের বাজেট কমানো যাবেনা। বড় ব্র্যান্ডগুলোর সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে মার্কেটিং বাজেট কমে যাওয়া। কোথাও হয়তো অর্ধেকে নেমে এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই এই অল্প টাকা স্বল্পমেয়াদী কার্যসম্পাদন মার্কেটিং (performance marketing) এবং বিক্রয় প্রসারের কাজেই ব্যয় করা শ্রেয় বলেই অনেকেই মনে করতে পারেন। এটা হবে মারাত্মক ভুল। দ্রুত বিক্রির জন্য আবেদনময়ী ক্রেতা প্রণোদনা অথবা বিক্রয় বৃদ্ধির চাতুর্যপূর্ণ কর্মকাণ্ড কোনটা দিয়েই বর্তমানে ভয়ার্ত, ঘরে বন্দি , ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত ভোক্তাদের ক্রয়ে প্ররোচিত করা যাবে না। মার্কেটিং বাজেট অর্ধেকে নেমে আসলেও দীর্ঘমেয়াদী ব্র্যান্ড বিল্ডিং কাজেই এটা ব্যয় করা উচিত। এটা না করে কার্যসম্পাদন মার্কেটিং চেষ্টা বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যর্থ হতে বাধ্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও টেলিভিশন বিজ্ঞাপন বাড়াতে হবে। যৌক্তিক আবেদন এবং প্রচ্ছন্ন নিশ্চয়তা বেশি কার্যকর হয়। বিশেষজ্ঞদের স্বীকৃতি, সনাতনভাবে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব এবং সন্তুষ্ট ক্রেতার প্রশংসার প্রতি অডিয়েন্সের আগ্রহ থাকে। এ সময় সেলিব্রিটিদের স্বীকৃতি তেমন আবেদন সৃষ্টি করে না। ক্রেতাদের জন্য ক্রয় করার পরামর্শ দেয়ার মত সুর বিজ্ঞাপনে না থাকাই ভালো। জনসংযোগ কার্যক্রম এসময়ে জোরদার করতে হবে। করোনা সংকটের সময় কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে মানুষের জন্য কার্যক্রমগুলোর ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা নিতে হবে। কাজটা যথাযথ নৈপুণ্যের সাথে করতে না পারলে ‘লোক দেখানো’ কর্মকান্ড হিসাবে এটা কোম্পানির ইমেজ ক্ষুন্ন করতে পারে। বিক্রয় প্রসার হাতিয়ার হিসেবে ডিসকাউন্ট বা প্রিমিয়াম কিছুটা কাজে আসলেও লটারি, ‘লাকী কুপন’ কোন কাজে আসবে না। তবে ক্রেতা আনুগত্যের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। বিক্রয় কর্মীদের ক্রেতাদের জিজ্ঞাসার জবাবের ব্যাপারে পূর্ব প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং আপত্তি মোকাবেলার কৌশলও তাদের শিখাতে হবে।
মন্দার সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাজারজাতকরণ মিশ্রণ হাতিয়ার হচ্ছে বন্টন। বণ্টন এসময়ে আরও বেশি গুরুত্ব পাবে। বন্টন প্রণালীতে যারা কম দামে পণ্য বিক্রি করে যেমন- ভোক্তা ক্লাব, ডিসকাউন্ট হাউস এবং পাইকারি বিক্রয় কেন্দ্রের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিতে হবে কারন তারাই সবচেয়ে কম দামে ভোক্তাদের নিকট পণ্য বিক্রয় করতে পারে। অলাভজনক দোকানে বিক্রয় বন্ধের এটাই সময়। অনেক সময় মাঠ পর্যায়ের বিক্রয়কর্মীরা দোকানদারের সাথে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ও চক্ষু লজ্জার খাতিরে এসকল অলাভজনক বিক্রেতার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে। অলাভজনক সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অনলাইন সহ বিভিন্ন বিকল্প চ্যানেলগুলোর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।
==========================================

সংকটকালে মার্কেটিং কেমন হবে, কিভাবে এই সময়ে টিকে থাকা যাবে এ নিয়ে একই শিরোনামে সাতটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার পর অনেকেই মেসেঞ্জারে ইনবক্স করে অথবা এসএমএস পাঠিয়ে জানিয়েছে, এগুলো কেবলমাত্র কোম্পানি এবং কর্পোরেট সেক্টরের লোকদের জন্য লিখা। যারা অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ছোট দোকানদার, মৌসুমী ব্যবসায়ী যেমন- ফলের মৌসুমী ফল, আলুর মৌসুমে আলু, কোরবানির সময় চামড়া, অথবা ছোটখাটো যখন যেটা সুযোগ টুকটাক ব্যবসা করে জীবন নির্বাহ করে তাঁরা বলেছে আগের লেখাগুলোতে তাঁদের জন্য কোন সুপারিশ নেই। সবকটা লেখাই লেখা হয়েছে বিবিএ এমবিএ পাস করা কর্পোরেট পিপলদের জন্য। যারা কখনো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মার্কেটিং পড়েনি বা বিবিএ-এমবিএ করেনি কিন্তু মার্কেটিং করে জীবিকা চালাচ্ছে তাদের জন্য সহজ করে কিছু লিখার জন্য অনুরোধ করেছে। তাদের অনুরোধ রাখতে গিয়ে এই নতুন সংস্করণ অর্থাৎ হালকা গল্পের মাধ্যমে মার্কেটিং এর গুরুত্বপূর্ণ কনসেপ্টগুলো সুস্পষ্ট করাই আগামী কয়েকটি প্রবন্ধের লক্ষ্য]

(১) নীড(Need): দুই বা ততোধিক পক্ষের মধ্যে বিনিময়ের মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপন এবং সম্পর্ক টিকিয়ে রাখাই বাজারজাতকরণ। বিনিময় করতে গেলে কমপক্ষে দুটি পক্ষ থাকতে হয়। দুইজনেই কিছু একটার বিনিময়ে অন্য কিছু একটা গ্রহণ করে। বিনিময়ের আরেকটি শর্ত হচ্ছে এটি হতে হবে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে। দুই পক্ষের মধ্যে দেয়া-নেয়ার ঘটনা ঘটলেও সেটা বিনিময় নাও হতে পারে। যেমন- এক চাঁদাবাজ এক ব্যক্তিকে একটি থাপ্পর দিল আর ওই ব্যক্তিটি চাঁদাবাজকে ৫০০ টাকা দিল। এখানে বিনিময় হল, চাঁদাবাজ থাপ্পর দিল আর থাপ্পর খাওয়া ব্যক্তি ৫০০ টাকা দিল, এটা কোন বিনিময় না । কারণ এটা আপোষের মাধ্যমে হয়নি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ যখন পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে পরস্পর কিছু একটা বিনিময়ের সুযোগ পায় তখন সে কি পেতে চায়?

*এক পন্ডিতমশাই দীর্ঘদিন যাবৎ পাঠশালায় তাঁর ছাত্রদেরকে বুঝালেন দুনিয়াতে জ্ঞানই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। “জ্ঞানই আলো” , টাকা পয়সা কিছুই না; আজ আছে কাল নেই। জ্ঞান হচ্ছে অমূল্য সম্পদ। তোমরা কখনও টাকা পয়সার লোভ করবা না। জ্ঞানটাকেই আঁকড়ে ধরবে। ছাত্রদের মধ্যে ধারণাটি বদ্ধমূল করার জন্য পন্ডিত মশাই জিজ্ঞেস করলেন তোমরা বিষয়টা ভালোভাবে বুঝেছো তো? ছাত্ররা বলল বুঝেছি, “জ্ঞানই অমূল্য সম্পদ” । এর কিছুদিন পর পাঠশালায় ইন্সপেক্টর আসলো। ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন শ্রেণিকক্ষে গেলেন। বিভিন্ন প্রশ্ন করলেন ছাত্রদেরকে। এক ক্লাসে গিয়ে ছাত্রদের বিদ্যানুরাগ এবং বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা করার জন্য শেষ প্রশ্ন করলেন, “মনে করো তোমাদের সামনে দুইটি বস্তা আছে, এক বস্তায় প্রচুর টাকা আর এক বস্তায় জ্ঞান আছে , এর মধ্যে একটি বস্তা নিতে বললে তোমরা কোন`টা নিবে। প্রশ্ন শুনে ছাত্ররা হতচকিত হয়ে গেল। সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না কি বলবে, সবাই অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল। হঠাৎ করেই পিছন থেকে এক ছাত্র বলে বসলো, “টাকার বস্তা নিব”। ইন্সপেক্টর চলে গেলেন। পণ্ডিতমশাই ছাত্রদের উপর অনেক রাগ করলেন। বললেন, “তোদেরকে আমি কত করে বুঝালাম, ‘টাকা আজ আছে কাল নেই। বিদ্যা অমূল্য সম্পদ, সব সময় বিদ্যাকে আঁকড়ে ধরবি। এত বুঝানোর পরও তোরা কি না উল্টোটাই করলি। আরে বোকার দল, আমাকে যদি কেউ এমন একটা সুযোগ দিত ‘এক বস্তা টাকা আর এক বস্তা বিদ্যার’ মধ্যে আমি কোন’টা নিব। অবশ্যই আমি বিদ্যা নিতাম।” তখন টাকার বস্তা নিতে চাওয়া ছাত্রটি দাঁড়িয়ে বলল “পণ্ডিতজি, যার যেটা কম আছে সে তো সেটাই নিবে।”

‘নীড’ এর কাছাকাছি বাংলা শব্দ হচ্ছে ‘তাড়না’। তাড়না যাদের বুঝতে অসুবিধা হয় তাঁদের জন্য আরেকটি কাছাকাছি শব্দ ‘যাতনা’। যাতনা কাকে বলে এটা বোধহয় সংজ্ঞা দেয়ার দরকার নেই। “জীবনে আমরা যত যাতনায় পড়েছি তাকে যাতনা বলে”। অতএব মানুষ যখন কোন কিছু পেতে চায়, যা দিয়ে তার যাতনা মিটবে সেটাই সে প্রথম চাইবে। এই করেনা সঙ্কটের কালে বিক্রেতাকে বুঝতে হবে মানুষ কি যাতনার মধ্যে আছে। সেই যাতনাটা ধরতে পারলেই এবং জুতসই একটি সমাধান দিতে পারলেই যাতনাটা মিটে যাবে। অতএব অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বলবো আপনার আশেপাশে থাকা লোকদের যাতনাটা বুঝার চেষ্টা করুন এবং তাঁর সমস্যাটা সমাধানের জন্য একটি পণ্য বা সেবা হাজির করুন । পণ্য বা সেবা হচ্ছে ভুক্তভোগীর সমস্যার একটি সমাধান।

(২) ঋণাত্মক চাহিদা (Negative Demand): কোন কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাকেই চাহিদা বলে না । সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার সামর্থ্য থাকতে হবে, অর্থাৎ মানুষ কিছু একটা পেতে চায় এবং এর জন্য তাঁর সামর্থ্য আছে এবং সেই সামর্থ্য (টাকা) ব্যয় করার ইচ্ছা আছে তখনই সেই পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে চাহিদা বলা হবে। নেগেটিভ চাহিদা হচ্ছে চাহিদার সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা। চাহিদা পূরণের জন্য কোন কিছু পেতে যেখানে ব্যক্তি টাকা খরচ করতে রাজি আছে এর বিপরীতে নেগেটিভ চাহিদা হচ্ছে ব্যক্তি কোন কিছুর জন্য টাকা খরচ করতে রাজি আছে, তবে সেটা পাওয়ার জন্য নয়, না পাওয়ার জন্য। অর্থাৎ পন্যটি যাতে তাকে না নিতে হয় সেজন্য কিছু টাকা খরচ করতে রাজি আছে।

* বাংলাদেশে অনেকগুলো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা এনজিও আছে যারা মাদকাসক্তদের নিয়ে কাজ করে। মাদকাসক্তি নির্মূল করাই তাদের লক্ষ্য। মনে করুন আপনি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের মাঠ কর্মকর্তা হিসাবে চাকরি পেলেন। সেখানে আপনার কাজটা কি হবে? মাদকাসক্তদের এই আসক্তি দূর করতে হবে,

তবে এটা অবশ্যই আপনার আসল কাজ না। মাদকাসক্তকে মাদক ছাড়ানো তেমন কোনো কঠিন কাজও না। আবদ্ধ করে ৪০ দিন ঘরে কোয়ারেন্টাইন রাখা গেলে সে নিজেই মাদক ছেড়ে দিবে। প্রথম প্রথম বেশ হৈচৈ করবে এবং মনে হবে যে মাদক না পেলে এই বুঝি তার জীবন চলে যাবে, মরে যাবে, আসলে মরবে না। তাছাড়া কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করলে মাদকাসক্তদের মাদক ছাড়ানো তেমন কঠিন কিছু না। মাদক ছাড়াতে পারলেই সমস্যাটির সমাধান হবে না, যদি না তাকে একটি কাজ দিয়ে পুনর্বাসন না করা যায়। কোন কাজ না থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই সে আবার মাদক নিতে শুরু করবে। অতএব মাদক ছাড়ানোর পরে ওই ব্যক্তির জন্য একটা চাকরি জোগাড় করে দেয়া হবে আপনার চাকরির বড় চ্যালেঞ্জ। ধরা যাক প্রত্যেক মাসে আপনার দুইজন সাবেক মাদকাসক্ত ব্যক্তির চাকরির ব্যবস্থার দায়িত্ব নিতে হয়। চলতি মাসে দুইজনকে আপনার চাকরি জোগাড় করে দিতে হবে। আপনার মামার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি আছে। এই মাসের জন্য ভাগে পাওয়া দুই সাবেক মাদকাসক্তকে নিয়ে আপনি গেলেন মালিবাগে অবস্থিত আপনার মামার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে। মামার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকের চাহিদা প্রতিদিনই থাকে। অনেকেই অন্য গার্মেন্টসে চলে যায়, বেশি বেতনের আশায়। তাই প্রতিদিনই লোক নিতে হয়। গার্মেন্টস শ্রমিকের চাহিদা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে একটি নৈমিত্তিক ব্যাপার। টাকা দিয়ে শ্রমিকের শ্রম কেনে। আপনি মামাকে বললেন, “মামা তুমি তো রোজই লোক নাও আমার এই দুইজন সাবেক ড্রাগ আ্যডিক্টকে তোমার ফ্যাক্টরিতে কাজ দাও।” মামা চাকরি প্রার্থী দুই সাবেকের দিকে তাকিয়ে আপনাকে বলল, “ভাগিনা (অথবা ভাগিনি) ওরা এখানে বসুক, তুমি একটু আমার সাথে ভিতরে আসো”। মামা আপনাকে ভেতরের রুমে নিয়ে ড্রয়ার থেকে ১০ হাজার টাকা বের করে আপনার হাতে দিয়ে বলল,” শুনেছি তুমি নাকি চাকরির পাশাপাশি ইভিনিং এমবিএ করছো” ।আপনি বললেন, “জী মামা”। মামা জিজ্ঞেস করল, “তোমার টিউশন ফি কত?” আপনি বললেন, “মাসে ১০ হাজার টাকার মতো।” মামা বলল, “আজ এই ১০ হাজার টাকা নিয়ে যাও, প্রতিমাসে এসে এখান থেকে ১০ হাজার টাকা করে নিয়ে যাবে, তবু তোমার এই এক্স-ড্রাগ অ্যাডিক অ্যাডিক্টদের আমার কারখানার দিকে এনো না।” মামা এক্সদের হাত থেকে বাঁচতে মাসে ১০ হাজার টাকা করে খরচ করতে রাজি আছে। এটাই নেগেটিভ ডিমান্ড।

জীবনে আপনাকে এমন পণ্যও বিক্রি করতে হতে পারে। আপনার পণ্য কেনা তো দূরের কথা আপনার পণ্য বা সেবা না পাওয়ার জন্য মানুষ টাকা খরচ করতে চাইবে। সাবেক মাদকাসক্তদের মত সাবেক স্বামী বা স্ত্রীকে বিয়ে করাতে গেলও আপনাকে একই অবস্থায় পড়তে হবে। অর্থাৎ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বর-কনের জন্য পাত্র-পাত্রী জোগাড় করা অত সহজ হবে না । চাকরির কাজে অভিজ্ঞতার অনেক দাম। অভিজ্ঞতা না থাকলে চাকরি হয় না। এন্ট্রি লেভেলের চাকরির জন্যেও চাকরিদাতারা অভিজ্ঞতা চেয়ে বসে। অনেকটা যেন অভিজ্ঞতা নিয়েই মানুষ জন্মায়। তবে বিয়ের বাজারে অভিজ্ঞতার দাম নেগেটিভ। স্বামী বা স্ত্রী হিসেবে দুই সংসারে তিন বছরের অভিজ্ঞতা থাকলে এখানেও নেগেটিভ চাহিদার মোকাবেলা করতে হবে। আমি নিজেই একবার বিপদে পড়েছিলাম আমাদের এক বন্ধুকে নিয়ে । বন্ধুটি সুজন-সুদর্শন, ভালো চাকরি করে। কিন্তু দুইবার ডিভোর্স খাওয়া। আমরা কাছে থেকেই জানি দুই বারই আমাদের বন্ধুটির কোন দোষ ছিলনা । কপাল খারাপ, দুইবারই অনেক সুন্দরী দেখে বিয়ে করে। দুই বারই ছিল ঝামেলাযুক্ত সুন্দরী। বউদেরও তেমন কোন দোষ ছিলনা। দুই বউই চলে যায়। কিছুদিন পর আমরা বন্ধুরা তাকে তৃতীয়বার বিয়ে করানোর জন্য চেষ্টা শুরু করি। যে মেয়েকে প্রস্তাব দেই সেই মেয়েই চা-নাস্তা খাওয়ানোর পর বিদায় করে দেয় এই বলে, “আর কাজ পান না, যে ব্যাটার দুইবার বউ গেছে তাঁরে বাদ দিয়া কথা বলেন।” এক্স-হাজবেন্ড বা এক্স-ওয়াইফ সম্পর্কে বেশিরভাগ লোকরই ধারণা হচ্ছে, “এত ভাল হলে কি তিনি ডিভোর্স খেয়েছেন। নিশ্চয়ই কোনো দোষ ছিল।” সাধারণ ধারণা হচ্ছে , কোন দোষ না থাকলে কি বউ/স্বামী তাঁকে ছেড়েছে। আসলে কি তাই ? অনেকেরই ডিভোর্স হয়েছে কোন দোষ না করেও। বিভিন্ন কারণেই সেটা হতে পারে। আপাতত ভাগ্যে ছিল এটা বলাই ভালো। কিছুতেই আমাদের বন্ধুটির জন্য মেয়ে জোগাড় করতে পারছিলাম না। এক পর্যায়ে একটি মেয়েকে টার্গেট করে তাকে রাজি করানোর দায়িত্ব বন্ধুরা আমাকে দিল। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একই কথা শুনতে হলো, “যেই ব্যাটার দুইবার বউ গেছে তাকে কে বিয়ে করে।” আমি আস্তে আস্তে মেয়েটিকে বুঝলাম, “তোমার কথা ধরে নিলাম ছেলেটি দোষ ছিল, তাহলেতো স্বামী হিসাবে সেই সবচেয়ে ভালো স্বামী হবে । আগের বউ চলে গেছে যে কারণে নতুন সংসারে সে আর এই দোষের কাজগুলো করবে না। স্বামী হিসেবে সে অনেক নরম(soft) হবে। কারণ সে ইতোমধ্যেই জেনে গেছে ‘দুইবার বউ চলে গেছে, এইবার বউ গেলে আর বউ পাওয়া যাবে না।” আমার এই কথাটা ভালোভাবে কাজ করেছে। কয়েকদিন বোঝানোর পর মেয়েটি রাজি হয়ে গেল। আমাদের বন্ধুর তৃতীয় বিয়ে হল। বিয়ের পর বন্ধুটি একেবারেই ঘরকুনো হয়ে গেল। দীর্ঘদিন তাকে কোথাও দেখা গেল না। বছর তিনেক পর একদিন হঠাৎ করে নিউমার্কেটে বন্ধুটির সাথে দেখা। সাথে ভাবি ও তাঁদের ছোট্ট একটি ফুটফুটে বাচ্চা। এটা-সেটা জিজ্ঞেস করে ভাবিকে কানেকানে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ ভাবি হাজবেন্ড কেমন?’ ভাবিও কানে কানে বলল, ঠিকই বলেছিলেন ভাই, “খুবই নরম”।

এক্স-ড্রাগ এডিক্টদের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যেতে পারে। যেকোনো কারণে বা যেকোনো ভাবেই কেউ ড্রাগ নিলে সে একেবারে শেষ হয়ে গেছে এমনটি মনে করার কোন কারণ নেই । এক্স-ড্রাগ অ্যাডিক্টরা বরং কঠোর পরিশ্রমী হয় এবং কষ্টসহিষ্ণু হয়। অনেকেই পরবর্তী জীবনে ভালো কর্মী হয়। বিভিন্ন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে সাবেকরা ভালোভাবে কাজ করছে। এ সকল কর্মীদের একটা তালিকা হাতে রাখলে গার্মেন্টস মালিকদেরকেও সাবেক মাদকাসক্তদের নিয়োগের জন্য রাজি করানো যাবে। নেগেটিভ ডিমান্ড মোকাবেলায় সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে ক্রেতার মনে বিষয়টি সম্পর্কে পূর্ব থেকেই যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়ে আছে তা দূর করা। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা পরিবর্তন না করে এ ধরনের কোন কিছু বিক্রির করার চেষ্টা করলে সফল হওয়া যাবে না।…( চলবে)
========================================
কেউ যদি এমন পণ্য বাজারে নিয়ে আসে যা একেবারেই অভিনব, জীবনে কেউ এর নামও শুনেনি, দেখেওনি এবং পণ্যটি ব্যবহারের সাথে কিছুটা হলেও ঝুঁকি জড়িত আছে তখন এ ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রে শূন্য চাহিদার পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ব্লক সুপারভাইজাররা যখন নতুন কোন চাষ পদ্ধতি বা নতুন কোন জাতের বীজ নিয়ে কৃষকের কাছে যায় তখন তাদের এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। নতুন জাতের লাউয়ের বীজ, প্রতি পাতার গোড়ায় লাউ ধরবে; ১০টা বীজ মাত্র এক টাকা দাম। তাও কৃষকরা নিবে না, কারণ তাদের ভয় নতুন জাতের লাউ গাছে যদি লাউ না ধরে। কৃষি বিভাগের লোকেরা তো লাউয়ের বীজ দিয়ে চলে যাবে । লাউ গাছে লাউ ধরে দুই তিন মাস পর। তখন যদি দেখা যায় লাউ ধরছে না। তাহলে কি হবে ? আগের বছরের জানাশোনা লাউয়ের বীজের উপরেই তাদের আস্থা। গত বছর লাউ ধরেছিল, এবারও ধরবে । ঝুঁকি নিয়ে লাভ নেই। প্রকৃতপক্ষেই কখনো কখনো নতুন জাতের বীজ থেকে ফল নাও আসতে পারে। এমন অভিজ্ঞতা দুই একবার যে কৃষকের হয়নি তাও নয়।
>>>>>
>>>>> *গ্রামের বাড়িতে আমার পড়ার ঘরের সামনে ছোট একটা ফুলের বাগান ছিল। ১৯৭৬ সালে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ঢাকায় চলে এলাম বাগানটির যত্ন করার মতো কেউ ছিলনা। এক বৃষ্টির দিনে আব্বা কোথা থেকে যেন একটা লাউয়ের চারা এনে বাগানের এক পাশে লাগিয়ে দিল। বাগানের বাইরে যে খালি জায়গাটুকু আছে সেদিকে গাছটি সম্প্রসারিত হবে। কিন্তু দেখা গেল আমার বাগানের দিকেই লাউ গাছটির বাড়ার আগ্রহ। তখন ফুলের বাগানের উপরেই মাচা বানিয়ে সুযোগ করে দেয়া হলো এবং লাউ গাছটিও মনের আনন্দে আমার ক্ষয়িষ্ণু ফুলের বাগানের উপরে জায়গা করে নিতে লাগলো। বেশ কিছুদিন পর আমি বাড়িতে গিয়ে দেখি আমার ফুলের বাগানের পুরোটাই লাউ গাছ দখল করে নিয়েছে। আমার খুব রাগ হল। আমার রাগ আরো বেড়ে গেল কারণ পুরো লাউ গাছটিতে একটি লাউও ধরেনি। এ নিয়ে যখন উচ্চস্বরে চেঁচামেচি করতে লাগলাম, ফুল বাগানে কেন লাউ গাছ লাগানো হলো ? তাও যদি দেখতাম যে লাউ ধরেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি । আমি যতই চেঁচামেচি করছি মা তখন দূরে থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছেন । মাকে জিজ্ঞেস করলাম হাসছেন কেন? লাউ কোথায় ? মা তখন জবাব দিলেন , “তোর আব্বা যখন লাউ গাছ লাগায় তখনই আমি বাধা দিয়েছিলাম। ফুলের বাগানের পাশে লাউ গাছ লাগালে তুই বাড়ি আসলে রাগ করবি। তোর আব্বা কিছুতেই আমার বাধা মানল না। বলল, “লাগাই, শাক-টাক খাওয়া যাবে” । আব্বা নাকি শাক খাওয়ার নিয়্যত করেই লাউ গাছ লাগিয়েছিল । অতএব গাছে শাক ধরেছে লাউ ধরেনি। (“ইন্নামাল আ’মালু বিন্নিয়াত ” –বুখারী শরীফের প্রথম হাদিস)।
>>>>>
>>>>> আমার আব্বা না হয় শখ করে লাউ গাছ লাগিয়েছিলেন এবং শাক খেলেন। কিন্তু লাউ চাষী যদি নতুন বীজ লাগিয়ে দুই তিন মাস পরে দেখে তার কেবল শাক হচ্ছে, লাউ নেই। তখন কি হবে ? ঢাকায় তো আমরা লাউ শাক কিনে খাই, প্রতি ডগার দাম ১০টাকা। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে একটা সময় লাউ শাক একেবারেই বিক্রি হয় না, গরুও লাউ শাক খায় না। পেঁপের চারার ঝুঁকি আরো বেশি। দশটি পেঁপের চারা লাগালে পাঁচ ছয়টা পুরুষ পেঁপে গাছ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। লাউ গাছে লাউ না ধরলেও শাক খাওয়া যায়। পুরুষ পেঁপে গাছ কুঁচি কুঁচি করে কেটে মনের ক্ষোভ কমানো ছাড়া আর কোনো কাজে লাগে না। তাই পেঁপের চারা অত সহজে বিক্রি করা যায় না। কাকরাইল এজিবি অফিসের আশেপাশে এক পেঁপের চারা বিক্রেতাকে দেখেছি একটি ভ্যান গাড়ির উপর একটি ড্রামের মধ্যে একটি বড় পেঁপে গাছ নিয়ে ঘুরতে। গাছটির গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত পেঁপে ধরে আছে । ড্রামের পাশেই অনেকগুলো পেঁপের চারা রাখা আছে। সে দর্শকদের বলছে, “দেখুন এই হচ্ছে সেই চারা যা থেকে এই রকম একটি গাছ হবে , আর গাছের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত পেঁপে ধরবে। নতুন জাতের লাউ এর ক্ষেত্রেও একই কাজ করতে হবে । কৃষিদপ্তরকে প্রথম বছর দর্শনীয় স্থানে প্রদর্শনী খামার তৈরি করতে হবে। নতুন বীজ বপন করে কৃষকদের দেখাতে হবে পাতায় পাতায় লাউ ধরেছে। এর পরের বছর কৃষকরা নিজেরাই নতুন বীজ গ্রহণ করবে। ইদানিং প্রদর্শনী খামারের বিকল্প হচ্ছে গ্রামে-গঞ্জে ভিডিও প্রদর্শন করা। তবে অনেকেই আবার ভিডিওতে কারসাজি আছে বলে এটা বিশ্বাস করতে চায়না। গ্রামে-গঞ্জে প্রদর্শন ও উপস্থাপনের কোন বিকল্প নেই । আমাদের সিলেট ও আসামে ব্রিটিশরা যখন চা বাগান তৈরি করে তখন এদেশে অল্প কিছু লোকই জানতো চা কি ? কেন খায় ? কিভাবে তৈরি করতে হয় ? ইত্যাদি কিছুই জানা ছিলনা এই অঞ্চলের লোকদের। ব্রিটিশরা গাছের ডগার পাতা দিয়ে উন্নত মানের চা বানিয়ে ইউরোপ নিয়ে যাবে। কিন্তু গাছের অপেক্ষাকৃত মোটা পাতাগুলোর কি হবে? তখনই ব্রিটিশরা ভাবলো এদেশে একটা চায়ের বাজার তৈরি করতে হবে যাতে তাদের ডাস্টগুলো বিক্রি করা যায়। ব্রিটিশরা তখন যেটা করলো, বাজারে বাজারে গিয়ে আসর জমিয়ে চা বানাতে লাগলো এবং বিনামূল্যে সবাইকে চা খাওয়ালো। আসরগুলোতে হালকা বিনোদনের জন্য দোতারা গানের ব্যবস্থা থাকতো। চা খাওয়ার পর চা দুধ চিনি প্যাকেট করে সবাইকে দিতে লাগল যাতে বাড়িতে নিয়েও চা খেতে পারে। চা একটি নেশা জাতীয় পানীয়, এই অর্থে কেউ কিছু দিন চা খেলে নেশা ধরে যাবে। না খেয়ে থাকতে পারবে না, মাথা ধরে যায়। যারাই বিনা পয়সায় চা খেল তাদের চায়ের নেশায় পেয়ে বসলো। গভীর রাত পর্যন্ত মানুষ বাজারে চায়ের আসরের চার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো চা খাওয়ার জন্য এবং চায়ের উপকরণ বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এক পর্যায়ে যখন ভিড় সামলাতে পারল না তখন ব্রিটিশরা বলল এখানে চা খাওয়া যাবে, বাড়িতে নেয়া যাবে না। তবু ভিড় কমলো না। শুধু চা খাওয়ার জন্য মানুষ রাত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতো। এক পর্যায়ে ভিড় কমানোর জন্য প্রতি কাপ চা সিকি পয়সা দাম ধার্য করা হলো। (ষোল আনায় এক টাকা, ৪ সিকি পয়সায় এক আনা। সিকি পয়সার মাঝখানে একটা ছিদ্র ছিল। ছোটবেলায় এমন ছিদ্রওআলা পয়সা আমরা দেখেছি। এখন জাদুঘরে গেলে এগুলো দেখা যাবে)। সেই যে সিকি পয়সা দাম ধরা হলো, এখন এক কাপ চায়ের দাম চারশত টাকা । হোটেল রেডিসন ব্লু তে একটি বিস্কুট আর এক কাপ চা ৪৭০ টাকা, ৭০ টাকা বিস্কুটের দাম হলে চায়ের দাম ৪০০ টাকা । এটাকে বলা হয় ‘মার্কেট পেনিট্রেশন স্ট্র্যাটিজি’ (market penetration strategy) । শূন্য থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে উপরের দিকে যাওয়া। অপরদিকে নতুন পণ্য যদি এমন হয় পণ্যটি সম্পর্কে মানুষ আগে থেকেই জানে । একদল লোক যেকোনো মূল্যে পণ্যটি পেতে চায়। পণ্যটির কোন প্রতিযোগী নেই। তেমন কোনো বিকল্পও নেই । যেমনটি হয়েছিল বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে যখন প্রথম মোবাইল ফোন আসে আশির দশকের শেষের দিকে তখন মানুষ এ সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনে গেছে। যেখানে যাবেন সেখানেই মোবাইল ফোন যাবে। অসাধারন এক অনুভূতি । একদল লোক এই সুবিধার কথা শোনা মাত্রই বলতে লাগলো, ‘আমার এটা চাই, যত টাকা লাগে লাগুক মোবাইল ফোন চাই’। সুযোগটা নিল সিটিসেল। সিটিসেল কোম্পানি বর্তমানে বিলুপ্ত এবং মালিকরা পলাতক। এরশাদ সরকারের সাথে সিটিসেল চুক্তি করলো আগামী দশ বছর এদেশে অন্যকোন মোবাইল ফোন কোম্পানি আসতে পারবেনা। ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তদানীন্তন টেলিকমিউনিকেশন মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম মন্ত্রী হওয়ার পর হাইকোর্টে মামলা করে মামলায় জিতে সরকারকে গ্রামীণফোনের অনুমতি দিতে হয়েছিল। সিটিসেল কোম্পানি প্রথম দিকের প্রতিটি মোবাইল ফোন বিক্রি করেছিল ১ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা করে। বিক্রি যখন একটু কমে আসলো প্রতি সেটের দাম ধরা হলো দেড় লক্ষ টাকা । এভাবেই কমতে কমতে ২৫ হাজার টাকা, দশ হাজার টাকা, ৫০০০ টাকা‌। এক পর্যায়ে বলা হল সেটের দাম নেই মাসিক বিল দিলেই চলবে । এই পদ্ধতিটাকে বলা হয় market skimming strategy বা সর তোলা কৌশল। Skimming হচ্ছে দুধের সর তোলা । দুধ জ্বাল দিয়ে ঠান্ডা করে সর তোলা হয়। আবার জ্বাল দিয়ে আবার ঠান্ডা করে সর তুলতে হয়। এই প্রক্রিয়াটি কয়েকবার করার পর সর উঠা বন্ধ হয়ে যায়। তখন অবশিষ্ট দুধ মাঠা হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়। অন্য পাত্রে রাখা সর জ্বাল দিয়ে ঘি তৈরি করা হয়। অতি উচ্চ দাম থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামতে হয়। বাজারে সর তোলা মূল্য কৌশল ফলপ্রসূ হয় কতগুলো শর্ত সাপেক্ষে। প্রথমত, পণ্যটির উচ্চমূল্য এর মান ও ভাবমূর্তি দ্বারা সমর্থিত হতে হবে এবং এই উচ্চ মূল্যে প্রচুর সংখ্যক ক্রেতা পণ্যটি পেতে চাইবে। দ্বিতীয়ত, সীমিত সংখ্যক পণ্য উৎপাদনের ব্যয় এত বেশী হবেনা যার দ্বারা উচ্চমূল্যের সুবিধাটুকু বিলীন হয়ে যাবে। সবশেষে, প্রতিযোগীর পক্ষে সহজে বাজারে প্রবেশ সম্ভব হবে না এবং উচ্চ মূল্যের বাজারকে প্রতিযোগী কম মূল্যের পণ্য দ্বারা দখল করতে পারবে না।
>>>>>
>>>>> (৪) সুপ্ত চাহিদা (Latent Demand): মার্কেটিং সংশ্লিষ্টদের বড় একটা কাজ হচ্ছে নতুন কিছু বাজারের ছাড়া । যে পণ্য (ক্রেতার সমস্যার সমাধান ) বাজারে নেই সেই পণ্য বাজারে নিয়ে আসা । যারা নতুন করে ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করতে চান তাদের জন্যও বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ । যে পণ্য বাজারে আছে তারই একটি হুবহু সংস্করণ ভিন্ন নামে ভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ছাড়া হলে এটা বাজারে কোন সারা জাগাতে পারে না। ভোক্তার এমন চাহিদা থাকতে পারে যা বর্তমানে বাজারে পাওয়া যাওয়া কোন পণ্য দিয়েই মিটছে না অথবা পণ্যটি আছে কিন্তু ভোক্তা তথ্য অথবা অর্থের অভাবে সেটা পাচ্ছে না। ভোক্তার নিড আছে কিন্তু তাঁর আরধ্য পণ্যটি যে পাওয়া যাচ্ছে সে সম্পর্কে অবগত নয় । আর্থিক কারণে যারা পণ্যটি কিনতে পারছে না তাদেরকেও এই শ্রেণীভুক্ত করা হয়। স্টার্টআপ কোম্পানিগুলো এই সুযোগটা নিতে পারে। প্রত্যেক ভোক্তা তাঁর সমস্যার শতভাগ জুৎসই সমাধান চায়। অনেক শক্তিশালী সুপ্ত চাহিদা থাকতে পারে। ক্যামব্রিজ ডিকশনারি অনুযায়ী সুপ্ত চাহিদা হচ্ছে, “demand for a product or service that a consumer cannot satisfy because they do not have enough money, because the product or service is not available, or because they do not know that it is available. তিনটি কারণে ক্রেতার মনে এ ধরনের পণ্যের সুপ্ত চাহিদা থাকে:
>>>>> ১. ভোক্তার কাছে পণ্যটি ক্রয় করার মতো অর্থ নেই
>>>>> ২. পণ্যটি বাজারে নেই
>>>>> ৩. পণ্যটি বাজারে আছে ভোক্তার কাছে কোন তথ্য নেই
>>>>> এছাড়াও ভোক্তার কিছু একটা প্রয়োজন কিন্তু সেই প্রয়োজনটা যে কি সে সবসময় সুস্পষ্ট করে বলতে পারে না। তবে অন্য কেউ বলে দিলে এমন পণ্যটি পাওয়ার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে সেটাও সুপ্ত চাহিদার অন্তর্গত। বর্ষার সিজনে বড় একটা সমস্যা হচ্ছে সন্ধ্যার দিকে গরম লাগে, রাতে বৃষ্টি হলে ভোর বেলায় অনেক ঠান্ডা লাগে। যারা রাতে ঘুমানোর সময় জোরে ফ্যান চালিয়ে ঘুমান ভোর বেলায় তাঁরা শীত অনুভব করে । ফ্যানের বাতাস খুব ঠান্ডা লাগায় ফ্যানটি বন্ধ করতে চায়। বন্ধ করতে হলে সুইচ টিপতে হয়, সেটা বেড সুইচ হলেও। অথবা আজকাল রিমোট কন্ট্রোল পাখা বাজারে পাওয়া যায় যা দিয়ে পাখার গতি কমানো এবং বাড়ানো যায়, বন্ধ করা যায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ভোর রাত্রে অঘোর ঘুমের মধ্যে রিমোট টিপবে কে ? যদি থার্মোস্ট্যাট যুক্ত একটি পাখার ব্যবস্থা করা যেত যা ঘরের তাপমাত্রা অনুযায়ী পাখাকে ঘুরাবে অর্থাৎ তাপমাত্রা বেশি হলে পাখা জোরে ঘুরবে, তাপমাত্রা কমে গেলে পাখার ঘুরার গতি নিজেই শ্লথ হয়ে যাবে এবং ঘরের তাপমাত্রা একটা নির্দিষ্ট মাত্রা কমে চলে গেলে পাখা আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যাবে। এই থার্মোস্টেটটি লাগাতে পাখা প্রতি মাত্র ২০০ টাকা খরচ হবে। এই ডিভাইসের কথা যদি কেউ শোনে, যে কোনদিন এটা কল্পনাও করে নাই, সেও বলে বসবে আমার অবশ্যই এটা লাগবে। এটাই সুপ্ত চাহিদার একটি উদাহরণ। আমি সব সময় ভাবি যদি চর্বিযুক্ত খাসির মাংসের কাচ্চি বিরিয়ানীর পাওয়া যেত যেটা কোলেস্টেরলমুক্ত হবে, তাহলে নিয়মিত কাচ্চি বিরিয়ানী খেতাম। অনেকে বলে নিকোটিন বিহীন সিগারেট যদি থাকতো। ইদানীংকালে অনেকে বলছে ঘরে যদি অক্সিজেন ফ্লো অব্যাহত রাখার মত কম খরচে একটি স্বয়ংক্রিয় অক্সিজেন মেশিন থাকতো, ইত্যাদি । বহু কিছু মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে এবং মনে মনে খুঁজছে বাজারজাতকরনকারীর কাজ হচ্ছে এ ধরনের পণ্যের বাজারের আয়তন নিরূপণ করা এবং জুৎসই পণ্য উন্নয়ন করা যা দিয়ে মানুষ অতৃপ্ত চাহিদা পরিতৃপ্ত করবে। নতুন পণ্য দুই প্রকার ইনোভেটিভ(innovative) এবং ইমিটেটিভ(imitative)। ইনোভেশন জটিল ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। অনেক কোম্পানিতে এজন্য R&D বিভাগ থাকে তাঁরা অনবরত উন্নয়নের কাজটি করে। কিন্তু ছোট উদ্যোক্তা বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর জন্য বেশি সহায়ক হতে পারে ভোক্তাদের ব্যবহৃত বর্তমান পণ্যগুলির সমস্যা খুঁজে বের করা। প্রশ্ন করলেই দেখা যাবে তাঁদের বাড়িতে এবং অফিসে অনেক পণ্য-সেবা-মেশিন ব্যবহার করে যেগুলোতে কোন না কোন ত্রুটি আছে। শতভাগ নিশ্চিত ফলাফলের জন্য এগুলোতে সংশোধন আনা প্রয়োজন। ব্যবহারকারীরা সংশোধনী নিয়ে জ্ঞান রাখে কিন্তু প্রযুক্তি এবং অবকাঠামোগত অসুবিধার কারণে সেটা তাঁরা করতে পারে না। যা কেবল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে করা সম্ভব। আমরা যত গৃহস্থালী পণ্য বা যন্ত্র ব্যবহার করি ব্যবহারের কয়েকদিনের মধ্যেই পণ্যটির সীমাবদ্ধতা টের পেয়ে যাই । একবার খুব পছন্দ করে বাথরুমে ব্যবহার করার জন্য একটি মগ কিনে নিয়ে আসলাম, কিন্তু ব্যবহার করতে গিয়ে দেখলাম মগটির হাতল ৯০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে মগের সাথে ফিক্সড করা। এটা রাখার জন্য বাথরুমের জায়গা পাচ্ছিলাম না । বেসিনে রাখলে হাত লেগে বারবার নিচে পড়ে যায়। বালতির ভিতর রাখলে শ্যাওলা ধরে যায়। তখনই আমার মনে হলো যদি মগটি বালতির সাথে ঝুলিয়ে রাখা যেত, কিন্তু এটা আমার পক্ষে করা সম্ভব না। কেবলমাত্র মগ উৎপাদনকারী প্লাস্টিক কোম্পানিই সেটা করতে পারে। গোসলের সাবানগুলোর বড় একটা সমস্যা হচ্ছে প্রথম দুই তিন দিন এগুলো খুব পিচ্ছিল থাকে। যার কারণে গায়ে মাখার সময় হাত থেকে ফসকে যায়। আর গোসল করার সময় হাত থেকে সাবান ফসকে গেলে বিশেষ করে সেটা যদি নতুন সাবান হয় অবধারিতভাবেই সেটা কমোডে গিয়ে পড়বে। সাবান হারানো ছাড়াও এতে আরো নতুন সমস্যা দেখা দেয়। সাবানের পিচ্ছিল ভাব প্রথম দুই তিন দিন থাকলেও পরে সেটা ড্রাই হয়ে কেটে যায়। অতএব সাবানে যদি খাঁজ কেটে দেয়া হয় অথবা সাবান যদি একটু বাঁকা করে দেয়া যায় তা সহজে হাত থেকে পড়বে না। সাবান হারানো এবং কমোডে সাবান পড়ার কারণে সৃষ্ট জটিলতা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এ ধরনের ব্যবহার্য পণ্যগুলোতে প্রত্যেকটিতেই সমস্যা আছে। ব্যবহারকারীদের জিজ্ঞেস করলেই ইমিটেটিভ প্রোডাক্ট এর ধারনা পেতে কোন অসুবিধা হবে না। ভোক্তাদের অংশগ্রহণে ফোকাস গ্রুপ আলোচনা এবং in-depth ইন্টারভিউ এর মাধ্যমে এটা করা যেতে পারে। সম্ভাব্য বাজারটি পরিমাপ করে সে অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করতে হবে। ভোক্তারা যেন পণ্যটির জন্য ব্যয় করতে তাড়িত হয় সেজন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আর্থিক সমস্যার ব্যাপারে কিস্তিতে অথবা বিলম্বে মূল্য পরিশোধের সুযোগ রাখা যেতে। যারা নতুন করে স্টার্টআপ করতে চাচ্ছেন এমন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য এই পরামর্শ কাজে আসতে পারে। এক্ষেত্রে পণ্য মান এবং মূল্যের ভিত্তিতে চারটি কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। প্রথম কৌশলটি হচ্ছে “প্রিমিয়াম কৌশল”। বিদ্যমান পণ্যের সাথে অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য যোগ করে মান উন্নত করা এবং দাম বাড়িয়ে দেওয়া। অনেকটা “জিনিস যেমন দামও তেমন”। ঢাকা শহরে কিছু কিছু মিষ্টি বিক্রেতা প্রিমিয়াম কৌশল গ্রহণ করে সফলতা পেয়েছে। সনাতন মিষ্টির ধারণাটি তাঁরা বদলে দিয়েছে। ভোক্তারা মিষ্টি খেলেই বুঝতে পারে এটি আগের কোন মিষ্টির মত নয়। অত্যন্ত উন্নতমানের, অতএব বেশি দাম দিতে তাঁদের আপত্তি থাকে না । তবে মন্দা অর্থনীতির সময় এই কৌশলটি তেমন কাজে আসবে না। দ্বিতীয় কৌশলটি হচ্ছে পণ্যের মান বাড়িয়ে দাম কমিয়ে দেওয়া “গুড-ভ্যালু” কৌশল। এক্ষেত্রে সমস্যাটা হবে বেশির ভাগ মানুষের ধারণা ভালো জিনিসের দাম বেশি হয় কিন্তু এক্ষেত্রে দাবি করা হচ্ছে ভালো জিনিসের দাম কমে গেছে । এই বিষয়টি তাদের যদি ভালো করে বোঝানো যায় তাহলে সফলতা পাওয়া যেতে পারে। জিনিসটি ভালো বলেই বাজারে বেশি চলছে যার কারণে প্রতিষ্ঠানটি তার উৎপাদন ক্ষমতার শতভাগ ব্যবহার করতে পারছে। উৎপাদন ক্ষমতা শতভাগ ব্যবহার করার কারণে একক প্রতি উৎপাদন খরচ কমে গেছে অতএব মূল্য কম রাখা গেছে। তাছাড়া পণ্যটি ক্রেতারা টেষ্ট করে যদি দেখে যে সত্যি সত্যি পণ্যের মান বেড়ে গেছে তাহলে কম দামের ব্যাপারে তাদের কোন সন্দেহ থাকবে না । আরেকটি কৌশল হচ্ছে “ওভার চার্জিং”স্ট্র্যাটিজি। আমি এটার নাম দিয়েছিলাম “গলাকাটা” কৌশল। পণ্য থেকে কিছু বৈশিষ্ট্য সরিয়ে ফেলে আরো সাদামাটা করে উচ্চ মূল্য ধার্য করা। সারা পৃথিবীতে কিছু সংখ্যক ক্রেতা আছে তাদের ধারণা যে পণ্যের দাম যত বেশি সেটাই সবচেয়ে ভালো পণ্য। আবার কিছু লোক মনে করে উচ্চ মূল্যের পণ্য সবাই কিনতে পারবে না । সে উচ্চমূল্য দিয়ে পণ্যটি কিনে মর্যাদাবান হবে। সে একাই পণ্যটি কিনেছে, আশেপাশে কেউ কিনতে পারছে না উচ্চ মূল্যের কারণে, এটাই তাঁর আনন্দ। কোরবানির সময় সর্বোচ্চ দামে বাজারের সবচেয়ে বড় গরুটি কেনার পেছনে এই মনস্তত্ত্ব কাজ করে। তবে এই কৌশলটি কেবলমাত্র সীমিত পরিসরে প্রয়োগ করা যাবে। অ্যান্টিক জাতীয় আইটেমের ক্ষেত্রে এই কৌশলটি গ্রহণ করা হয়। অর্থনৈতিক মন্দার সময় সবচেয়ে ভালো কৌশলটি হবে “মিতব্যয়িতার” কৌশল। ‘অত ভালোও দরকার নাই, আর অত দামেরও দরকার নাই’। অর্থাৎ পণ্যটিকে সাদামাটা করে মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো রেখে কম দামে পণ্যটি বাজারে ছাড়া। মন্দার সময় মানুষ পণ্যের বাহুল্যের চেয়ে আবশ্যকীয়তাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। স্টার্টআপ কোম্পানিগুলো এই “মিতব্যয়িতার” কৌশল অবলম্বন করে করোনা কালীন সময়ে বা করোনা পরবর্তী সময়ে তাদের ব্যবসা শুরু করার চিন্তা করতে পারে।…(চলবে)।
=======================================